বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
১. ভূমিকা:
বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে ও মনন গঠনে যে কয়জন কবির অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক ধ্রুবতারা, আমাদের জাতীয় কবি। প্রেম, দ্রোহ, সাম্য ও মানবতার মূর্ত প্রতীক তিনি। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো বিস্ময়কর ও তেজোদীপ্ত। তিনি একাধারে বিদ্রোহী এবং প্রেমিক। তাঁর কবিতায় যেমন শোষকের বিরুদ্ধে খড়গ কৃপাণ জ্বলে উঠেছে, তেমনি প্রেমিকার চরণে নিবেদিত হয়েছে ফুলের অঞ্জলি। দেশভাগের সময় বা পরবর্তীতে নজরুলকে কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সীমানায় আবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাই তো অন্নদাশঙ্কর রায় আক্ষেপ ও গর্বের সুরে লিখেছেন:
“ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো নজরুল।”
সত্যিই নজরুল অখণ্ড বাঙালি সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে জাতিকে শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। তাঁর কবিতা ও গান আজও কোটি বাঙালির হৃদয়ে সাহসের সঞ্চার করে। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর হৃদয়ে ছিল গভীর মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
২. জন্ম ও শৈশবকাল:
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমাধীন চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। নামটি যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। শৈশবেই তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ-কষ্ট। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। পিতার অকাল মৃত্যুতে পরিবারটি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। অভাব-অনটনের সংসারে দুমুঠো ভাতের যোগান দিতে শিশু নজরুলকে কঠোর জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। দারিদ্র্যের কশাঘাত তাঁর শৈশবকে ম্লান করে দিলেও তাঁর ভেতরের প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় পীরের মাজারে খাদেম এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করেছেন। এই শৈশবের অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যে ইসলামি ঐতিহ্যের সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
৩. শিক্ষা জীবন:
নজরুলের শিক্ষা জীবন ছিল বিচিত্র ও ভবঘুরে স্বভাবের। অভাবের তাড়নায় তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। গ্রামের মক্তবে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯১০ সালে তিনি লেটো দল ছেড়ে আবার স্কুলে ভর্তি হন। প্রথমে তিনি রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (বর্তমান নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) পড়াশোনা করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে আবার পড়ালেখা ছাড়তে হয়। এরপর পেটের তাগিদে তিনি আসানসোলে এক রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি পুঁথি পড়তেন এবং মুখে মুখে ছড়া কাটতেন। তাঁর এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ তাঁকে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর স্কুলে (বর্তমান নজরুল একাডেমি) সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৪ সালে তিনি আবার চুরুলিয়ায় ফিরে যান এবং সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ সালে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই তিনি দেশমাতৃকার সেবায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং এর মাধ্যমেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
৪. পারিবারিক জীবন:
কবির পারিবারিক জীবন ছিল প্রেম ও বিরহের এক অনন্য উপাখ্যান। ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরে সৈয়দা খাতুন নামের এক কিশোরীর সাথে (যার নাম তিনি দিয়েছিলেন নার্গিস) নজরুলের বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের রাতেই ‘ঘরজামাই’ থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে অভিমানী কবি বাসর সজ্জা ত্যাগ করে চলে আসেন। নার্গিসের সাথে তাঁর সংসার করা হয়নি। পরবর্তীতে কুমিল্লায় থাকাকালীন তিনি প্রমীলা দেবীর সাথে পরিচিত হন এবং প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল প্রমীলা দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কবি তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়েছিলেন ‘আশালতা’। ধর্মে ভিন্নতা থাকলেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ। সংসার জীবনে তাঁরা বুলবুল, সানি এবং নিনির মতো সন্তানদের জনক হন। তবে প্রিয় পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু কবির পারিবারিক জীবনে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছিল।
৫. কর্মজীবন:
নজরুলের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল খুব অল্প বয়সে এবং তা ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও সংগ্রামমুখর। পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে মাত্র দশ-এগারো বছর বয়সে তিনি মক্তবে শিক্ষকতা, মাজারের খাদেম এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর তিনি যোগ দেন গ্রামের লেটো দলে, যেখানে তিনি পালাগান রচনা ও অভিনয়ে দক্ষতা দেখান। পরবর্তীতে রেলওয়ের এক গার্ডের খানসামা এবং আসানসোলের রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজও করেছেন তিনি। এই কায়িক শ্রমের দিনগুলো তাঁকে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের সাথে পরিচিত করিয়েছে, যা তাঁর পরবর্তী সাহিত্যকর্মে রসদ জুগিয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এছাড়াও তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে এবং আকাশবাণীতে কাজ করেছেন।
৬. সৈনিক জীবন:
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দশম শ্রেণির ছাত্র নজরুল পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে করাচি চলে যান। সেখানে তিনি সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সৈনিক জীবন নজরুলের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ব্যারাকের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। করাচি সেনানিবাসে বসেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের সাথে পরিচিত হন এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ এবং প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ এই সৈনিক জীবনেই রচিত। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয় এবং তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।
৭. সাংবাদিক জীবন:
সৈনিক জীবন শেষে কলকাতায় ফিরে নজরুল সাংবাদিকতাকে পেশা এবং নেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মালিকানাধীন ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’ এবং ‘গণবাণী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলো ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিত। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্ভীক ও আপোষহীন। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন।
৮. রাজনৈতিক জীবন:
নজরুল কেবল কলমযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের সংস্পর্শে এসে তিনি সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি শ্রমিক-কৃষক রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবল আবেদন-নিবেদনে স্বাধীনতা আসবে না, এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র বিপ্লব। ১৯২৫ সালে তিনি ফরিদপুরে কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন। রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের কারণে এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লেখার জন্য তাঁকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়। হুগলি জেলে তিনি রাজবন্দীদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘ অনশন করেছিলেন।
৯. সাহিত্যকর্ম:
বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে নজরুলের পদচারণা ছিল না। মাত্র ২২ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি বিপুল ও বিচিত্র সম্ভার রেখে গেছেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’, যা বাংলা কবিতায় এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফনী-মনসা’, ‘জিঞ্জীর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়-শিখা’ উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলি মালা’র মতো গল্পগ্রন্থ এবং ‘বাঁধন হারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’র মতো উপন্যাস রচনা করেছেন। নাটক, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সাহিত্য—সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন স্বকীয়। তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে গান। তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন, যা নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত। গজল, খেয়াল, ঠুংরি, শ্যামা সঙ্গীত, ইসলামি গান, ভাটিয়ালি—গানের সব শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল অসামান্য।
১০. বিদ্রোহী নজরুল:
কাজী নজরুল ইসলামের নামের সাথে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর থেকেই তিনি এই অভিধায় ভূষিত হন। এই কবিতায় তিনি নিজেকে সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এক প্রলয়কারী শক্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি লেখেন—
“বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!”
তাঁর বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে একটি শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তো তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত...”
১১. অসুস্থতা:
নজরুলের জীবনের ট্র্যাজেডি শুরু হয় ১৯৪২ সালে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। প্রথমে হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করা হলেও কোনো ফল হয়নি। ১৯৫২ সালে তাঁকে রাঁচির মানসিক হাসপাতালে এবং ১৯৫৩ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডন ও ভিয়েনায় পাঠানো হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন যে, কবি ‘পিকস ডিজিজ’ (Pick's Disease) নামক এক জটিল নিউরনঘটিত রোগে আক্রান্ত, যা থেকে আরোগ্য লাভ অসম্ভব। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক ও নিথর জীবনযাপন করেন। যেই কণ্ঠ একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়।
১২. বাংলাদেশে আগমন:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও ভালোবাসা দিয়ে বরণ করা হয়। ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য সরকারিভাবে একটি বাসভবন বরাদ্দ দেওয়া হয় (যা বর্তমানে নজরুল ভবন নামে পরিচিত)। বাংলাদেশে আসার পর কবির চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এবং তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
১৩. কবির প্রয়াণ:
বাংলাদেশে আসার চার বছর পর কবির স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ৭৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর একটি গানের চরণ— “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই”— এই ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের উত্তর পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করে।
১৪. সম্মাননা: বাংলাদেশ:
স্বাধীন বাংলাদেশ কাজী নজরুল ইসলামকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে। তাঁকে ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত “চল্ চল্ চল্” গানটিকে বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ‘ডি.লিট’ উপাধি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং একই বছর তাঁকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদান করা হয়। কবির স্মৃতি রক্ষার্থে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ঢাকায় ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’।
১৫. সম্মাননা: ভারত:
ভারতে জন্মগ্রহণকারী এই মহান কবিকে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করেছে। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাঁকে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া এবং আসানসোল এলাকায় তাঁর নামে ‘কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া অণ্ডাল বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে ‘কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ রাখা হয়েছে। কলকাতা মেট্রোর একটি স্টেশনের নাম এবং একটি প্রধান সড়কের নামও কবির নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।
১৬. উপসংহার:
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতার কবি, সাম্যের কবি এবং যৌবনের কবি। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য। তাঁর হাতে বাঁশি এবং রণতূর্য—উভয়ই সমানভাবে বেজেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, শিল্প কেবল বিনোদনের জন্য নয়, তা শোষণের বিরুদ্ধে হাতিয়ারও হতে পারে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন সমাজকে গ্রাস করছিল, তখন নজরুল গেয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান। তিনি লিখেছিলেন, “গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।” তাঁর সাহিত্য ও দর্শন আমাদের জাতীয় জীবনের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা যেমন শক্তি জুগিয়েছে, তেমনি ভবিষতেও সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে তিনি আমাদের পথ দেখাবেন।
No comments
Thank you, best of luck