মানবকল্যাণে বিজ্ঞান
১. ভূমিকা:
মানুষের জীবনে বিজ্ঞান চেতনার দীপশিখা প্রথম জ্বলে উঠেছিল প্রায় দশ হাজার বছর আগে। আদিম গুহাবাসী মানুষ যেদিন প্রকৃতির প্রতিকূলতা জয় করার স্বপ্ন দেখেছিল, সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। সে সময় সভ্য মানুষ শুধু প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং অজানাকে জানার এবং দুর্বোধ্যকে বোঝার গভীর আগ্রহেই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে। সেই আদিম কৌতূহলের ধারাবাহিকতায় আজকের জীবন বিজ্ঞানের অসংখ্য আশীর্বাদে ধন্য। আজকের এই আলো ঝলমল আধুনিক সভ্যতা মূলত বিজ্ঞানেরই একক অবদান। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের এই সর্বজয়ী ও সর্বব্যাপী স্বরূপটি মানুষই তার নিরন্তর সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে। আদিমকালে জীবনকে আয়েসপূর্ণ, সুখময় ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে মানুষ যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, আজকের দিনের বিজ্ঞান তারই সুনিয়ন্ত্রিত, সুশৃঙ্খল এবং বিকাশমান প্রয়াস। তাই আজ বিজ্ঞান জীবনের শত ধারায় ও শত শাখায় বিস্তৃত হয়ে আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।
২. বিজ্ঞান কী?:
আভিধানিক অর্থে বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান। তবে ব্যাপক অর্থে, ভৌত বিশ্বে যা কিছু পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নামই বিজ্ঞান। বিভিন্ন মনিষী বিজ্ঞানকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। হারবার্ট স্পেন্সারের মতে, ‘বিজ্ঞান হলো সংঘবদ্ধ জ্ঞানের সমষ্টি।’ বিজ্ঞানী মাদাম কুরী আবেগের সাথে বলেছেন, ‘আমার চোখে বিজ্ঞান হলো অনিন্দ্য সুন্দর।’ বিজ্ঞানী ভ্যালেরীর মতে, ‘বিজ্ঞান হলো কতগুলো সাফল্যমণ্ডিত ব্যবস্থা ও ধ্যান-ধারণার সংগ্রহ।’ প্রমথ চৌধরীর মতে, ‘বিজ্ঞান শুধু একটি বিশেষ জ্ঞানের নাম নয়, একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে যে জ্ঞান লাভ করা যায় আসলে তারই নাম হচ্ছে বিজ্ঞান।’ সুতরাং, যুক্তিনির্ভর বিশেষ জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান।
৩. বিজ্ঞান চেতনার প্রসার:
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা একদিনে হয়নি। আদিম যুগে গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর মানুষের জীবনে প্রথম যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল আগুনের আবিষ্কার এবং কৃষিকাজের প্রচলন। কৃষিকাজের প্রয়োজনেই উদ্ভাবিত হয়েছিল আদি কৃষি যন্ত্র লাঙল। পরবর্তীকালে মানুষ শস্য সংরক্ষণ করতে শিখল এবং ফসল থেকে নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী বানানোর কৌশল আয়ত্ত করল। চাকা ঘুরিয়ে মানুষ বানাতে শুরু করল নানা ধরনের মাটির পাত্র। ইরাকের সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল। অন্যদিকে পানি তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনদেশে। গ্রিসের লোকেরা প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র তৈরি করে। এভাবেই মানুষের অদম্য কৌতূহল ও উদ্ভাবনী শক্তি যুগে যুগে বিজ্ঞান চেতনাকে প্রসারিত করেছে।
৪. আধুনিক বিজ্ঞান:
বর্তমান যুগ নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের যুগ। বর্তমান সভ্যতা সর্বতোভাবে বিজ্ঞানের দান। সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে মানুষ পরিপূর্ণ সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সভ্য সমাজের সর্বত্রই আজ বিজ্ঞানের গৌরবময় উপস্থিতি বিদ্যমান। নাগরিক সভ্যতার সামান্যতম অংশটিও এখন আর অবৈজ্ঞানিক নয়। আমাদের নগরের রাজপথ, দ্রুতগামী যানবাহন, গগনচুম্বী অট্টালিকা—সবই বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট। এখন সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে, পাখা ঘোরে, গান বাজে, টেলিভিশনের পর্দায় ছবি ভেসে ওঠে। নিমিষেই ওড়া যায় নীল আকাশে, এমনকি ভাঙা হাড়ও জোড়া লাগে বিজ্ঞানের জাদুতে। বিজ্ঞানের অসীম শক্তিতে মানুষ আজ প্রকৃতিকে যেন হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। শিল্প জগতে বিজ্ঞান নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দ্রুত উৎপাদনের তাগিদে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বিজ্ঞানের মহিমায় এখন সব কায়িক পরিশ্রমের কাজই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। বিজ্ঞানের ঐন্দ্রজালিক শক্তিবলে মানুষ উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল নদীর স্রোতকে বশীভূত করেছে, উষর মরু-প্রান্তরকে করেছে জলসিক্ত এবং ভূগর্ভের সঞ্চিত শস্য সম্ভাবনাকে করেছে উজ্জ্বল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বলেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
৫. বিস্ময়কর আবিষ্কার:
আধুনিক বিজ্ঞান সময় ও দূরত্বকে জয় করেছে, যা একসময় কল্পনারও অতীত ছিল। জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিন ও জর্জ স্টিফেনসন রেলগাড়ি আবিষ্কার করে যাতায়াত ব্যবস্থায় বিপ্লব আনেন। উড়োজাহাজের সাহায্যে আমরা ঘণ্টায় তিনশ মাইলেরও বেশি পথ অতি সহজে অতিক্রম করতে পারি। মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন, যা ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বিশাল মাইলফলক। টমাস আলভা এডিসন সেই বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে টেলিফোন, রেডিও ও টেলিভিশনের উৎকর্ষ সাধন করেন। মূলত আজকের আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ যন্ত্রই বিদ্যুৎ তরঙ্গের এই রহস্যময় শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
৬. মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান:
বিজ্ঞান পৃথিবীকে শুধু ছোটো করেই দেয়নি, বরং একটি বৃহত্তর ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা বিশ্বগ্রামে পরিণত করেছে। মানুষের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো।
৭. দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান:
প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিজ্ঞানের নানাবিধ আবিষ্কার ও উপকরণ নিয়ে আমাদের চলতে হয়। সকালে ঘড়ি দেখে ঘুম থেকে উঠে যে পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করি, তা বিজ্ঞানেরই অবদান। তারপর রান্নার চুলায় ভূ-গর্ভের গ্যাস, খাবারের টেবিলে পুষ্টি নির্দেশক খাদ্য, অফিস গমনে যান্ত্রিক যান, হিসাব করার জন্য ক্যালকুলেটর, দাপ্তরিক কাজে কম্পিউটার এবং অবসর বিনোদনে বিভিন্ন উপকরণ—এসব ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল। মোটকথা, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
৮. পরিবহণ ও যোগাযোগে বিজ্ঞান:
আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দিয়েছে অভাবনীয় সুবিধা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে মানুষের এখন সমান পদচারণ। স্থলপথে দ্রুতগামী গাড়ি ও বুলেট ট্রেন, জলপথে বিশাল জাহাজ এবং আকাশপথে শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী সুপারসনিক বিমান মানুষ আবিষ্কার করেছে। মানুষ এখন রকেটে চড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন গ্রহে। আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থারই প্রত্যক্ষ ফল।
৯. চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান:
চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান এনেছে এক যুগান্তকারী সাফল্য। চিকিৎসাক্ষেত্রে একদিকে টীকা বা প্রতিষেধকের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করা হচ্ছে, অন্যদিকে উন্নত ওষুধ ও শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে দুরারোগ্য রোগ নিরাময় করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস তথা রোগ-জীবাণু শনাক্তকরণ দ্বারা তা নির্মূলে কার্যকর উপায় বের করা হয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে এবং মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্পিউটারকেন্দ্রিক ‘টেলিমেডিসিন’ পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি এখন উন্নত দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। এক্সরে, ই.সি.জি, আলট্রাসনোগ্রাম, ইটিটি, এন্ডোস্কপিসহ আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে মানবদেহের জটিলতম রোগগুলো নির্ণয় করে সহজেই নিরাময় করা হচ্ছে। ব্রেইন সার্জারি ও ওপেন হার্ট সার্জারির মতো জটিল শল্য চিকিৎসায় সাফল্যের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
১০. শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
মানুষের জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প কারখানায় কোনো একসময় সমস্ত কাজই হাতে করা হতো। ফলে মানুষের কাজে সময় ও শ্রম লাগত বেশি, কিন্তু উৎপাদন হতো ন্যূনতম। বিজ্ঞানের বলে আজ সেসব কাজ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দ্বারা করানো হচ্ছে। ফলে খরচ ও সময় কম ব্যয় হচ্ছে এবং উৎপাদন হচ্ছে অধিক। বিজ্ঞানের বদৌলতে শিল্পবিপ্লবের ফলে আজ বৃহদায়তনের শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
১১. শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র শিক্ষাক্ষেত্রে এনে দিয়েছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। জ্ঞান ও শিক্ষণীয় কথাবার্তা মুদ্রণ যন্ত্রের কল্যাণে বই আকারে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মূল্যবান গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রচারিত হওয়ায় জ্ঞানের আদান-প্রদান সহজতর হয়েছে। বর্তমানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও দূরশিক্ষণের মাধ্যমে ঘরে বসেই উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল তৈরি ও প্রচার—সর্বক্ষেত্রে এখন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।
১২. কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে। প্রাচীন ভোঁতা লাঙলের পরিবর্তে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতমানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে। গবাদি পশু, মৎস্য, হাঁস-মুরগি পালনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ সুফল দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও ফলমূল পরিবহন এবং সংরক্ষণে (কোল্ড স্টোরেজ) বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ হচ্ছে। এককথায় কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান মহাবিপ্লব এনে দিয়েছে।
১৩. তথ্যপ্রবাহে বিজ্ঞান:
বর্তমান যুগ তথ্যবিপ্লবের যুগ। কম্পিউটার, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট সারা পৃথিবীকে একটি অভিন্ন যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আবদ্ধ করেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে যেকোনো মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কম্পিউটারকেন্দ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি (Information Technology - IT) জটিল গণনা থেকে শুরু করে অফিস ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে নির্ভুল গতি। স্যাটেলাইট যোগাযোগের কল্যাণে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো ঘটনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
১৪. মহাশূন্যের গবেষণায় বিজ্ঞান:
মানুষের কৌতূহলী মন আজ বিজ্ঞানের বলে মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হয়েছে। মানুষ চাঁদে ও মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান আরোহণের জন্য মহাশূন্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। মহাকাশে পাঠিয়েছে বিভিন্ন উপগ্রহ যান, রোবট ও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম। এছাড়া আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রেরণ করছেন কৃত্রিম উপগ্রহ, যার ফলে আবহাওয়ার খবরাখবর মুহূর্তের মধ্যেই নির্ভুলভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাচ্ছে। তাছাড়া ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ ও জলজ সম্পদের উৎস সম্পর্কেও জানা যাচ্ছে।
১৫. বিনোদনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
মানুষকে মানসিক প্রফুল্লতা দানের জন্য বিজ্ঞান দিয়েছে রকমারি উপকরণ। বিজ্ঞান আজ মানুষের নিত্যদিনের বিনোদন সঙ্গী। বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ভিসিডি, ক্যামেরা, স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র বিনোদন জগতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আজকের দিনে বিজ্ঞানের কল্যাণে গড়ে উঠছে ‘বিশ্ব সংস্কৃতি’। বর্তমানে চলছে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার। যেকোনো অনুষ্ঠান একই সঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে টেলিভিশনের পর্দায়। মুহূর্তের মধ্যেই জনপ্রিয় গান বা সিনেমা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে ইন্টারনেটের কল্যাণে।
১৬. ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে বিজ্ঞান:
পৃথিবীর এমন কোনো স্থান নেই যেখানে পুরকৌশল বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অবদান নেই। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন শত শত বিশাল ইমারত গড়ে উঠছে, পাহাড় কেটে রাস্তা হচ্ছে, নদীর বুকে সেতু গড়ছে। দুর্গম গিরিপথ, উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর অবলীলায় মানুষ অতিক্রম করছে বিজ্ঞানের প্রকৌশলবিদ্যার সাহায্যে। এছাড়া কৃষি-শিল্পেও প্রকৌশলবিদ্যার প্রয়োগে মরুভূমি আজ মনোহর উদ্যানে এবং বিরানভূমি জনারণ্যে পরিণত হচ্ছে।
১৭. বিশ শতকের বিজ্ঞান:
বিংশ শতাব্দী ছিল বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। বিশ শতকের বিজ্ঞানীগণ চন্দ্রালোকের অজ্ঞাত পরিবেশকে জানার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন এবং ইতোমধ্যে মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে। এছাড়া মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চলেছে। এসব কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে স্পুটনিক, ভয়েজার, পার্থফাইন্ডার প্রভৃতি মহাকাশযান।
১৮. একুশ শতকের বিজ্ঞান:
বিজ্ঞান তার আওতাকে একুশ শতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কেননা বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ পেয়েছে ‘মানব ক্লোনিং’-এর মতো ঘটনা। আর মানবদেহের ‘জিনোম সিকোয়েন্স’ আবিষ্কার এ শতকে বিজ্ঞানের আরও নতুন ও বিস্ময়কর কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর ব্যবহার এ শতকের বিজ্ঞানের অন্যতম সংযোজন।
১৯. বিজ্ঞানে অকল্যাণ:
আমাদের নিত্যজীবনে বিজ্ঞান শুধু আশীর্বাদই বয়ে আনেনি; অভিশাপও এনেছে। যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ দিন দিন শ্রমবিমুখ ও অলস হয়ে পড়ছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, মানব জন্মের সব গৌরব হারিয়ে মানুষ আজ যন্ত্রের দাস হয়ে উঠছে। এছাড়া বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে যেসব মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে তা শান্তিকামী মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। একই সাথে যা আশীর্বাদ, তা যে অভিশাপও হতে পারে তার প্রমাণও আছে অনেক। আলফ্রেড নোবেল পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে মানুষের যাতায়াতের টানেল কিংবা খনি থেকে খনিজদ্রব্য উত্তোলনের জন্য যে ডিনামাইট আবিষ্কার করেন, পরবর্তীতে যুদ্ধে তা-ই অসংখ্য প্রাণ সংহার করেছে। যে পারমাণবিক শক্তি মানুষের শক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে, তাই আবার নাগাসাকি ও হিরোশিমায় লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে।
২০. উপসংহার:
মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের দান সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাছে মানুষ ঋণী। বিজ্ঞানের দানে মানুষ আজ বিশ্বজয়ী। সভ্যতার ক্রমোন্নতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু কতগুলো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের যুগ-যুগান্তরের কীর্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞানের শক্তির ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তবে ভালোর পাশে মন্দের উপস্থিতি আলো-আঁধারের মতো লুকোচুরি খেলবেই। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান তাই অনেক ভালোর সাথে কিছুটা অপ্রীতিকরও বৈকি। তাই বিজ্ঞানের অকল্যাণকর দিকগুলোকে দূরে ঠেলে এর সুন্দর অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। তবেই এই মানব সমাজ উন্নত থেকে উন্নততর হবে এবং সমৃদ্ধি আসবে সমগ্র জগতের।
No comments
Thank you, best of luck