প্রার্থী (সুকান্ত ভট্টাচার্য) অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সাহিত্য কনিকা - কবিতা | NCTB BOOK
কবিতাটির সারসংক্ষেপ:
[প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা এই অংশটুকু প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রয়োজন। তাই এই অংশটুকু ভালো করে পড়বে।]
প্রচণ্ড শীতের রাতে দরিদ্র ও বস্ত্রহীন মানুষ সূর্যের প্রতীক্ষায় থাকে, যেমনটি কৃষক অপেক্ষা করে ধান কাটার মওসুমের জন্য। গরিব মানুষের কাছে শীতের রাত দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক, কারণ তাদের শীত নিবারণের মতো পর্যাপ্ত গরম কাপড় নেই। খড়কুটো জ্বালিয়ে, কান ঢেকে কোনোমতে তারা রাত পার করে। তাই সকালে এক টুকরো রোদ তাদের কাছে সোনার চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে হয়। রোদের একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল হয়ে ছোটাছুটি করে। কবি সূর্যের কাছে প্রার্থনা করেন, যেন সূর্য তাদের স্যাঁতসেঁতে ঘরে এবং রাস্তার ধারের বস্ত্রহীন শিশুটিকে উত্তাপ দেয়। তবে কবিতার শেষে কবি এক গভীর দর্শন তুলে ধরেন। তিনি জানেন সূর্য একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। তিনি আশা করেন, সূর্যের উত্তাপ গ্রহণ করে দরিদ্র মানুষরাও একদিন একেকটি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হবে—অর্থাৎ তাদের মধ্যে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠবে। সেই আগুনে তাদের স্থবিরতা বা জড়তা পুড়ে ছাই হবে এবং তখনই তারা সামাজিকভাবে সক্ষম হবে রাস্তার ধারের সেই উলঙ্গ ছেলেটিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে। কিন্তু সেই সুদিনের আগে, আজকের জন্য তাদের কেবল সূর্যের একটু অকৃপণ উত্তাপ প্রয়োজন।
হে সূর্য। শীতের সূর্য।
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি,
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে,
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই।
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর-
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই—
এক টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।
হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
হে সূর্য।
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও—
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই
এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হব।
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারব
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী
শব্দার্থ ও টীকা :
প্রার্থী — প্রার্থনাকারী, আবেদনকারী।
হিমশীতল — তুষারের মতো ঠান্ডা।
স্যাঁতসেঁতে — ভেজা ভাবযুক্ত।
অগ্নিপিণ্ড — আগুনের গোলা।
জড়তা — জড়ের ভাব,আড়ষ্টতা।
অকৃপণ — কৃপণ নয় এমন । উদার।
বিস্তারিত ব্যাখ্যা:
সুপ্রিয় শিক্ষার্থীরা, আজ আমরা যে কবিতাটি পড়ছি, সেটি লিখেছেন ‘কিশোর কবি’ সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুকান্ত ছিলেন গণমানুষের কবি। তিনি খুব অল্প বয়সে মারা যান, কিন্তু তাঁর লেখায় গরিব ও মেহনতি মানুষের কথা খুব শক্তিশালীভাবে উঠে এসেছে। চলো, আমরা কবিতাটির গভীরে গিয়ে এর প্রতিটি অংশের মানে বুঝি।
হে সূর্য। শীতের সূর্য।
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি,
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।
কবিতার শুরুতে কবি সূর্যকে সম্বোধন করছেন। তিনি বলছেন, শীতের রাত দরিদ্র মানুষের জন্য অনেক দীর্ঘ হয়। কেন জানো? কারণ, যাদের গায়ে লেপ-কম্বল নেই, তাদের কাছে শীতের রাত যেন শেষই হতে চায় না। কবি এই প্রতীক্ষাকে তুলনা করেছেন কৃষকের সাথে। কৃষক যেমন সারা বছর কষ্ট করে ধান কাটার দিনের অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি গরিব মানুষ শীতের রাতে সূর্যের জন্য অপেক্ষা করে।
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে,
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই।
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর-
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
এখানে কবি বাস্তবতার কঠিন রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি সূর্যকে বলছেন, “তুমি তো জানো আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!” শিক্ষার্থীরা, ভেবে দেখো, আমরা যখন শীতে জ্যাকেট বা সোয়েটার পরে আরাম করি, তখন দেশের বহু মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে থাকে। তাদের কাছে সকালের এক টুকরো রোদ বা রৌদ্র সোনার টুকরোর চেয়েও দামি। কারণ, সোনা দিয়ে তো আর শীত তাড়ানো যায় না, কিন্তু রোদের উত্তাপ তাদের হাড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচায়।
ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই—
এক টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।
হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
কবি সূর্যের কাছে নিজের জন্য কিছু চাননি, তিনি চেয়েছেন সবার জন্য। বিশেষ করে সেই ‘উলঙ্গ ছেলেটার’ জন্য, যার গায়ে কোনো কাপড় নেই। এখানে কবির গভীর মানবিকতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শিশুটির কথা ভেবেছেন।
হে সূর্য।
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও—
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই
এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হব।
শিক্ষার্থীরা, এই জায়গাটি খুব মন দিয়ে বোঝো। কবি সূর্যকে ‘জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড’ বলেছেন। তিনি চাইছেন, সূর্যের সেই আগুন যেন মানুষের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এখানে ‘অগ্নিপিণ্ড’ বা আগুন বলতে কবি বিপ্লব বা প্রতিবাদের শক্তি বুঝিয়েছেন।
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারব
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী
কবি মনে করেন, গরিব মানুষ এখন শীতে কাঁপছে, তারা দুর্বল। কিন্তু তারা যদি সূর্যের মতো তেজ বা শক্তি অর্জন করতে পারে, তবে তারা ‘জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে’ পরিণত হবে। অর্থাৎ, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে।
পাঠের উদ্দেশ্য:
এ কবিতা পাঠ করে শিক্ষার্থীদের মনে অবহেলিত, বঞ্চিত ও দীন-দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতা সৃষ্টি হবে। অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও আশ্রয়হীন মানুষের দুর্দশায় তারা ব্যথিত হবে।
পাঠ-পরিচিতি:
‘প্রার্থী' কবিতাটি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র' কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। আমাদের এই পৃথিবীতে শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্য যে তাপ বিকিরণ করে তার সাহায্যেই ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানুষ জীবনধারণ করে। প্রচণ্ড শীতে সূর্যের এই উত্তাপের জন্য সারারাত অপেক্ষা করে বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন শীতার্ত মানুষ ৷ কৰিব সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রতি গভীর মমতা থেকে সূর্যের কাছে উত্তাপ প্রার্থনা করেছেন। অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুর প্রতি তাঁর অসীম মমতা। কবি এই শিশুদের কল্যাণে সূর্যের অবদান থেকে প্রেরণা নিতে চান । তিনি এমন সমাজ গড়তে চান— যাতে বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষের জীবন থেকে সব দুঃখ চিরতরে ঘুচে যায়।
কবি-পরিচিতি
সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই সন্তান অল্প বয়সেই শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তোলেন। বামপন্থি-বিপ্লবী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বঞ্চনাকাতর মানুষের জীবন-যন্ত্রণার চিত্র যেমন তাঁর কবিতায় অঙ্কিত হয়েছে তেমনি প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের সুর উচ্চারিত হয়েছে। তিনি সেকালের দৈনিক পত্রিকা 'স্বাধীনতার কিশোর সভা অংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কবিতায় মানবমুক্তির জয়গান বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের নাম : ‘ছাড়পত্র’,‘ঘুম নেই’, ‘পূর্বাভাস’, ‘অভিযান’, ‘হরতাল' ও ‘গীতিগুচ্ছ'। সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
No comments
Thank you, best of luck