নারী, কাজী নজরুল ইসলাম
সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
কবি এখানে সাম্য বা সমতার গান গাইছেন। কবির দৃষ্টিতে বা বিচারে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বা ভেদাভেদ নেই। তাঁরা উভয়েই সমান।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
এই পৃথিবীতে যত মহান কাজ এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য যত কল্যাণকর সৃষ্টি হয়েছে, তার সবকিছুতে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। অর্থাৎ অর্ধেক কাজ করেছেন নারীরা আর বাকি অর্ধেক পুরুষেরা।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
শুধু ভালো কাজে নয়, পৃথিবীতে যত অন্যায়, পাপ, কষ্ট বা কান্নার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর দায়ও নারী-পুরুষের সমান। সুখের মতো দুঃখের ভাগীদারও উভয়েই।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
পৃথিবীর ইতিহাসে যত বড় যুদ্ধ জয় বা বিশাল সব অভিযান সফল হয়েছে, তার পেছনে মা, বোন এবং স্ত্রীদের বিশাল ত্যাগ রয়েছে। তাঁদের ত্যাগেই সেই সব ঘটনা মহান হয়ে উঠেছে।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কোন যুদ্ধে কতজন পুরুষ রক্ত দিয়েছেন বা মারা গেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে। কিন্তু কতজন নারী তাঁদের স্বামীকে হারিয়েছেন (সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে), সেই ত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
যুদ্ধে কত মা তাঁর সন্তানকে উৎসর্গ করেছেন, কত বোন সেবা-যত্ন করে উৎসাহ জুগিয়েছেন— সেই সব কথা বীরদের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে কেউ লিখে রাখেনি। অর্থাৎ নারীর অবদান আড়ালেই থেকে গেছে।
কোনো কালে একা হয় নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
কোনো যুগেই পুরুষ কেবল গায়ের জোরে বা তরবারি দিয়ে একা জয়ী হতে পারেনি। জয়ের দেবী বা লক্ষ্মীর মতো নারীরাই পুরুষকে সাহস, শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছেন বলেই পুরুষ বিজয়ী হতে পেরেছে।
সে-যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না কো, নারীরা আছিল দাসী।
সেই পুরনো সময় এখন শেষ হয়ে গেছে, যখন সমাজে পুরুষরা ছিল স্বাধীন, কিন্তু নারীদের দাসী বা গোলাম করে রাখা হতো। এখন আর নারীরা পিছিয়ে নেই।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি৷
আজকের যুগ হলো একে অপরের কষ্ট বোঝার যুগ, মানবতার যুগ এবং সমতার যুগ। এখন সাম্যের বা সমতার জয়ঢাক বাজছে, তাই কেউ আর কারও অধীনে বন্দী বা পরাধীন হয়ে থাকবে না।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে
পুরুষরা যদি অন্যায়ভাবে নারীদের বন্দী করে রাখে বা দাবিয়ে রাখে, তবে এর ফল তাদেরই ভোগ করতে হবে। নিজেদের তৈরি করা সেই ফাঁদে বা কারাগারে পুরুষদেরই ভুগতে হবে। কারণ নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।
যুগের ধর্ম এই—
পীড়ন করিলে সে-পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।
সময়ের নিয়ম বা ধর্মই হলো— তুমি যদি অন্যকে নির্যাতন বা কষ্ট দাও, তবে সেই কষ্ট বা নির্যাতন শেষ পর্যন্ত তোমাকেই আঘাত করবে। অর্থাৎ নারীকে কষ্ট দিলে পুরুষের জীবনও কষ্টের হবে।
সারসংক্ষেপ:
সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখেছেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর সকল মহান সৃষ্টি, সভ্যতা ও কল্যাণকর কাজে নারী ও পুরুষের অবদান সমান। অর্থাৎ মানবসভ্যতা নির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও সমান ভূমিকা রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে পুরুষের যুদ্ধের কথা বা আত্মত্যাগের কথা বড় করে লেখা থাকলেও, নারীর বেদনা, অশ্রু ও ত্যাগের কথা স্বীকৃত হয়নি। অথচ নারীর ভালোবাসা, সাহস, সেবা ও প্রেরণা ছাড়া পুরুষের কোনো বিজয়ই সম্ভব হতো না। মা, বোন ও স্ত্রীদের আত্মত্যাগেই পুরুষের জয় মহিমান্বিত হয়েছে। কবি মনে করেন, নারীদের অবহেলা করে বা দাসী করে রাখার দিন শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান যুগ সমতার যুগ বা মানুষের যুগ। এখন নারীকে আর ঘরের কোণে বন্দী করে রাখা যাবে না। কবি সতর্ক করে বলেছেন, নারীকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে বা তাদের ওপর নির্যাতন করলে সেই পরিণাম পুরুষদেরই ভোগ করতে হবে। কারণ নারীকে পিছিয়ে রেখে সমাজ বা জাতির উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তাই নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাই আজকের যুগের দাবি।
No comments
Thank you, best of luck