How to Talk So Kids Will Listen & Listen So Kids Will Talk - Adele Faber & Elaine Mazlish ভাবনা বাংলা ভাষায়
ভূমিকা: বইটি কেন এত জনপ্রিয়?
অভিভাবকত্ব আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন দক্ষতাগুলোর একটি। শিশুরা খুব সহজভাবেই আবেগ প্রকাশ করে। তারা দ্রুত রেগে যায়, কাঁদে, আটকে যায়, ভয় পায়, দ্বিধায় পড়ে, বড় হয়ে ওঠার পথে নানা মানসিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়। অন্যদিকে, বাবা-মা নিজেরা কাজ, ক্লান্তি ও দায়িত্বের চাপে থাকেন। ফলে ছোট ছোট ভুল বোঝাবুঝি বড় হয়ে যায়, এবং যোগাযোগে দূরত্ব তৈরি হয়।
Faber ও Mazlish বলেন— “শিশুকে পরিবর্তন করতে চাইলে প্রথমে তার অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিতে শিখুন।”
সহমর্মী যোগাযোগ:
১. শিশুদের অনুভূতি স্বীকার করার কৌশল :
কেন অনুভূতি স্বীকার করা জরুরি?
শিশুরা নিজেদের আবেগ প্রক্রিয়া করতে পারে না। তারা অনুভব করে, কিন্তু বোঝাতে পারে না।
যেমন—
“আমার জুতা হারিয়ে গেছে”—এতে তার ভয় কাজ করছে।
“ও আমায় মারল”—এতে তার অন্যায়বোধ।
“আমি স্কুলে যেতে চাই না”—এতে হয়তো উদ্বেগ রয়েছে।
অনেক অভিভাবক সরাসরি উত্তর দেন—
“এতে কাঁদার কী আছে?”
“এটা মোটেই বড় সমস্যা না।”
“চুপ করো, কিছু হয়নি।”
কিন্তু শিশু শোনে—
“আমার অনুভূতি গুরুত্বহীন।”
বই অনুযায়ী, সঠিক প্রতিক্রিয়া হলো—
“আমি দেখছি তুমি সত্যি চিন্তায় পড়েছ।”
“মনে হচ্ছে এটা তোমাকে বিরক্ত করছে।”
“তুমি ভয় পেয়েছ—ঠিক তো?”
সহমর্মিতার ৪ ধাপ
১. মনোযোগ দিয়ে শোনা:
শিশুটি কথা বললে শুধু শুনুন—সমাধান দিতে যাবেন না।
২. অনুভূতি শব্দবন্দী করা:
“তোমার মনে হচ্ছে…”
“তুমি তাই মনে করছ…”
৩. অনুমোদন দিন:
“এভাবে অনুভব করা স্বাভাবিক।”
শান্ত সময়ে সমাধান খোঁজা
যখন আবেগ কমে, তখন বিকল্প প্রস্তাব করুন।
ফলাফল: শিশু নিজেকে বুঝতে শেখে, সম্পর্ক গভীর হয়।
২. বাধ্য না করিয়ে সহযোগিতা পাওয়ার উপায়
শিশুকে আদেশ দিলে কী হয়?
সে প্রতিরোধ করে।
কারণ প্রতিটি মানুষই স্বাধীনতা চায়।
বইয়ে উল্লেখিত ৫টি কার্যকর কৌশল
১. বর্ণনামূলক নির্দেশ
“তোমার জামা মাটিতে পড়ে আছে”—এটি “জামা উঠাও!”–এর তুলনায় অনেক কার্যকর।
২. তথ্য দিন
“দুধ বাইরে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়।”
তথ্য শুনে শিশুর মনে দায়িত্ববোধ তৈরি হয়।
৩. এক শব্দের স্মরণ করানো
“জুতা।”
“হোমওয়ার্ক।”
এভাবে সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী।
৪. হাস্যরস ব্যবহার
“চলো কাপড়গুলোকে রোবট ভাঁজ করে দিই!”
হাস্যরস পরিবেশকে হালকা করে।
৫. তার সক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস দেখান
“আমি নিশ্চিত তুমি এটা করতে পারবে।”
৩. শাস্তি নয়—পরিবর্তনের উপায়
শাস্তি সাধারণত কার্যকর হয় না কারণ—
শিশুর মধ্যে বিরাগ জন্মায়
সে “কেন করব?” পরিবর্তে “কীভাবে বাঁচব?” শেখে
সম্পর্ক নষ্ট হয়
বইয়ের ৬টি বিকল্প কৌশল
১. অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিন
“আমি বুঝতে পারছি তুমি রেগে আছ।”
২. সমস্যার বর্ণনা দিন
“তুমি যখন গরম জিনিস ছুঁয়েছ, সেটা বিপদের।”
৩. প্রত্যাশা স্পষ্ট করুন
“খেলার জিনিস খেলা শেষে গুছিয়ে রাখতে হবে।”
৪. শিশুকে বিকল্প দিন
“এ খেলাটি রাখতে চাও, নাকি তুলে রাখতে সাহায্য করবে?”
৫. প্রাকৃতিক পরিণতির মুখোমুখি হতে দিন
যদি শিশু বারবার পানি নষ্ট করে, কম পানি পাওয়ার নিয়ম তৈরি করা—এটা শাস্তি নয়, পরিণতি।
৬. একসঙ্গে সমস্যা সমাধান
সমস্যা নির্ধারণ
সম্ভাব্য সমাধান তালিকা
সেরা সমাধান নির্বাচন
দায়িত্ব বণ্টন
৪. স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা ও আত্মসম্মান তৈরি
শিশুরা তখনই আত্মবিশ্বাসী হয় যখন তারা নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে শেখে।
কিন্তু অনেক সময় অভিভাবকরা—
“এটা তুমি পারবে না।”
“দেখো কিভাবে করতে হয়।”
এমন বলে উন্নতির পথে বাধা দেয়।
শিশুতে স্বাধীনতা গড়ার ৫ উপায়
১. বিকল্প দিন
“তুমি নীল জামা পরে যাবে না লাল?”
২. অসম্পূর্ণ কাজকে প্রশংসা নয়—উদ্যমকে সম্মান
“তুমি চেষ্টা করেছ, তাই এটা ভালো হয়েছে।”
৩. সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিন
“তোমার সময়মতো ৫ মিনিটে বিছানায় আসবে?”
৪. ভুল করার সুযোগ দিন
ভুল থেকেই শেখা সবচেয়ে স্থায়ী।
৫. সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিন
“তোমার মনে হয় কী করলে এটা ঠিক হবে?”
৫. প্রশংসা—যা শিশুকে তৈরি করে, ভাঙে না
অতিরিক্ত প্রশংসা শিশুকে নির্ভরশীল করে তোলে।
যেমন:
“তুমি দারুণ!”
“তুমি সেরা!”
এগুলো বাস্তবতা তৈরি করে না।
বইয়ের মতে—
সঠিক প্রশংসার নিয়ম
১. নির্দিষ্ট বর্ণনা দিন
“তুমি নিজে জুতা পরিষ্কার করেছ—আমি খুশি হয়েছি।”
২. শিশুর প্রচেষ্টা উল্লেখ করুন
“তুমি চেষ্টা করে এগুলো ছাঁটলে, তাই সুন্দর হলো।”
৩. উপলব্ধি শিশুদের নিজেরাই করতে দিন
“তুমি যেভাবে মনোযোগ দিয়ে রেখেছ, সেটা তোমাকে আরও ভালো করে তুলছে।”
এতে শিশু নিজের দক্ষতা সম্পর্কে নিজেই সচেতন হয়।
৬. শিশুর আগ্রাসন, রাগ, হিংসা—কীভাবে সামলাবেন?
শিশুরা অনেক সময় রেগে ঘুষি মারে, চিৎকার করে, ধাক্কা দেয়। অনেক অভিভাবক জোরে বকেন—
“চুপ করো!”
এতে শিশুর রাগ কমে না, আরও বাড়ে।
বইয়ের ৪ ধাপ
১. আবেগ স্বীকার করুন
“তুমি খুব রেগে গেছ।”
২. সীমা নির্ধারণ করুন
“তুমি রেগে যেতে পারো, কিন্তু কাউকে মারতে পারবে না।”
৩. নিরাপদ প্রকাশের উপায় দিন
“রেগে গেলে বালিশে আঘাত করো।”
“রঙ করো, লিখে ফেলো, দৌড়াও।”
৪. শান্ত সময় শেষে আলাপ করুন
“যখন তুমি মারো, তখন অন্যরা কেমন বোধ করে—জানো?”
এতে শিশু রাগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা শেখে।
৭. শিশুর ব্যক্তিত্বকে সম্মান করা
প্রতিটি শিশুর আলাদা স্বভাব—
কেউ চঞ্চল
কেউ শান্ত
কেউ সংবেদনশীল
কেউ বেশি প্রশ্নকারী
অভিভাবকরা তুলনা করলে শিশুর আত্মসম্মান কমে যায়।
তুলনার বদলে যা করতে হবে
১. শিশুর নিজস্বতা মেনে নিন
২. তার শক্তিগুলো চিহ্নিত করুন
৩. দুর্বলতাকে নিয়ে লজ্জা বা অপমান না করে সমাধানের পথ দেখান
৪. তার আগ্রহকে সম্মান করুন
Faber & Mazlish বলেন—
“শিশুকে আপনি যেভাবে দেখবেন, সে নিজেকে সেভাবেই দেখতে শুরু করবে।”
৮. ভাইবোনের সংঘাত—মানবিকভাবে সামলানো
বইয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ভাইবোনদের ঝগড়া হলে ভুল প্রতিক্রিয়া
কে প্রথম শুরু করেছে তা বের করা
পক্ষ নেওয়া
বকাঝকা
তাদের আলাদা করে শাস্তি দেওয়া
এতে ঘৃণা আরও বাড়ে।
সঠিক প্রতিক্রিয়া
১. অনুভূতি স্বীকার
“দেখছি তোমরা দু’জনই রেগে আছ।”
২. সংঘর্ষ বর্ণনা করুন
“তোমরা একই খেলনাটি চাও।”
৩. সীমা নির্ধারণ
“ঝগড়া করা যাবে, মারামারি নয়।”
৪. সমাধান খুঁজতে সাহায্য করুন
“একটা টাইমার সেট করি?”
“তোমরা কি পালা করে ব্যবহার করতে চাও?”
৫. মারামারি খুব বেশি হলে
“চলো, সবাই একটু আলাদা হয়ে শান্ত হই।”
৯. নিজের ভাষা—নিজের আচরণ: অভিভাবকত্বের আত্মবিশ্লেষণ
এই বই কেবল শিশুদের শেখানোর বই নয়;
এটি অভিভাবকের আত্ম–পরিবর্তনের বই।
অভিভাবকের ৬টি সচেতনতা
১. শিশুর চাহিদার গভীরতা বোঝা
২. কর্তৃত্ব নয়—সহযোগিতা
৩. সহমর্মিতা শেখা
৪. নিজের রাগ চিনতে শেখা
৫. পরিবারে সম্মান বজায় রাখা
৬. শান্ত ভাষা ব্যবহার
বইয়ের বার্তা পরিষ্কার—
“শিশু আপনার কথা নয়, আচরণ শিখে।”
১০. প্রয়োগের বাস্তব উদাহরণ
উদাহরণ ১: হোমওয়ার্ক না করলে
❌ “এখনই বসো!”
✔️ “তোমার কাজ আছে, কখন করবে—এটা তুমি ঠিক করতে পারো।”
উদাহরণ ২: সকালে স্কুলে যেতে দেরি
❌ “তুমি সব সময় দেরি করো!”
✔️ “এখন ৭:৪০—১০ মিনিট বাকি। তুমি কীভাবে তৈরি হবে বলে ভেবেছ?”
উদাহরণ ৩: বাজারে গিয়ে কান্নাকাটি
❌ “চুপ করো, নাহলে কিছুই পাবা না।”
✔️ “তুমি চাও খেলনাটি। কিন্তু আজ আমরা শুধু খাবার কিনতে এসেছি।”
উদাহরণ ৪: ঘর পরিষ্কার না করা
❌ “তুমি খুব এলোমেলো!”
✔️ “আমি দেখছি খেলনাগুলো মেঝেতে আছে। এগুলো গুছিয়ে ফেললে হাঁটাও সহজ হবে।”
১১. স্কুল, শিক্ষক ও পরিবারে ব্যবহারযোগ্য নির্দেশনা
এই বই শুধু অভিভাবকদের নয়—শিক্ষকদের জন্যও সমান কার্যকর।
শিক্ষকের করণীয়
১. শিশুর ভুলে লজ্জা না দেওয়া
২. জোর নয়—পরামর্শ
৩. সমঝোতা তৈরি করা
৪. শান্ত, স্পষ্ট নির্দেশ
5. সমস্যা হলে আলোচনা
ক্লাসের উদাহরণ
শিক্ষার্থী যদি বলে—“আমি করতে পারব না!”
শিক্ষক বলবেন—
“এটা কঠিন, আমি দেখছি। চলো, প্রথম ধাপটা একসঙ্গে করি।”
ফলে শিশুর শেখার ইচ্ছা বাড়ে।
১২. বইটির মূল শিক্ষা
এ বই আমাদের শেখায়—
শিশুকে বিচার নয়, বোঝার সুযোগ দিন
শিশুর মতো ভাবতে শিখুন
শিশুর আবেগের ভাষা বুঝুন
সমস্যা হলে শক্তি নয়—সংলাপ
প্রশংসা দিয়ে নয়—উদ্যম দিয়ে শক্তি দিন
স্বাধীনতা দিন
সম্মান দেখান
আত্মসম্মান বাড়ান
এটি শুধু একটি বই নয়;
এটি কার্যকর মানবিক যোগাযোগের সেরা প্রশিক্ষণ।
উপসংহার: কেন বইটি জীবন বদলে দেয়?
বইটির সারমর্ম দাঁড়ায়—
“শিশুকে ভালো মানুষ বানাতে চাইলে তার সাথে মানুষ হিসেবে আচরণ করুন।”
এই বই পড়লে অভিভাবক—
কম রেগে যান
বেশি বোঝেন
বেশি ধৈর্যশীল হন
পরিবারে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হন
শিশুরা—
আত্মবিশ্বাসী হয়
দায়িত্বশীল হয়
সহানুভূতিশীল হয়
নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে
No comments
Thank you, best of luck