শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
মানবজীবনে কৃতজ্ঞতাবোধ এক মহৎ গুণ, যা মানুষকে বিনয়ী ও উদার করে তোলে। কিন্তু সমাজে অনেকেই সামান্য উপকার করেও আত্মপ্রচারে ব্যস্ত হয়, যেন তারা অন্যের উপকার নয়, বরং নিজের গৌরব প্রকাশেই তৃপ্তি পায়। অথচ সত্যিকার মহৎ মানুষ উপকার করে নীরবে, বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করে না।
মানবচরিত্রের অন্যতম উৎকৃষ্ট দিক হলো উপকারীর উপকার স্বীকার করা। কিন্তু আত্মঅহমিকা, কৃতঘ্নতা ও সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে অনেকেই এই মহৎ গুণ হারিয়ে ফেলে। তারা পরনির্ভর হয়ে থেকেও দাতার প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ করে। “শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির”—এই পংক্তিতে সেই আত্মগর্বী মানসিকতার প্রতীকী চিত্র পাওয়া যায়। শৈবালের অস্তিত্বই দিঘির জলে, অথচ তুচ্ছ এক ফোঁটা শিশির গড়িয়ে পড়ায় সে মনে করে, যেন সে দিঘিকে কোনো মহৎ দান করেছে। বাস্তবে সে দিঘির উপর পরমুখাপেক্ষী ও ঋণী। এর মাধ্যমে কবি বা লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, মানবসমাজেও এমন অনেক সংকীর্ণচিত্ত মানুষ আছে, যারা অন্যের সাহায্যে জীবনধারণ করে, অথচ সামান্য কিছু দিয়ে নিজেদের মহত্ত্ব প্রচারে রত থাকে। এই আত্মঅহমিকা মানবতার পরিপন্থী। অপরদিকে, মহৎ মানুষ কারও উপকার করেও কখনো তা প্রচার করে না। তারা মানবসেবাকেই কর্তব্য মনে করে। তাদের উদারতা ও নীরব সেবাই প্রকৃত মানবধর্মের পরিচায়ক। “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক” ব্যক্তিরা যেমন সমাজে নীরবে মানবসেবা করে, তেমনি ইতিহাসের মহামানবরাও স্মরণীয় হয়েছেন আত্মপ্রচারে নয়, নিঃস্বার্থ কর্মে।
ইতিহাসে ও বর্তমান সমাজে উদার মানবতার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা কিংবা বাংলাদেশে ত্রাণকর্মে নিযুক্ত অসংখ্য নীরব সমাজসেবক কারও নাম প্রচার করে নিজের কৃতিত্ব প্রকাশ করেননি। তাদের কর্মই তাদের পরিচয় হয়ে উঠেছে। তারা দিঘির মতো গভীর, যে কারও শিশিরবিন্দুতুল্য অবদানকেও সাদরে গ্রহণ করে, কিন্তু নিজে গর্ব করে না।
অতএব, মানুষের উচিত শৈবালের মতো আত্মঅহমিকাপূর্ণ নয়, বরং দিঘির মতো উদার ও নীরব থাকা। কৃতজ্ঞতা মানুষকে উন্নত করে, আর আত্মগর্ব মানুষকে তুচ্ছ করে তোলে। পরনির্ভর হয়েও গর্ব নয়, বরং উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নিঃস্বার্থ পরোপকারের মানসিকতা মানবজীবনকে সত্যিকার অর্থে সুন্দর, মহৎ ও সার্থক করে তোলে।
No comments
Thank you, best of luck