header ads

নবম-দশম শ্রেণি।। কবিতা।। আমার দেশ।। সুফিয়া কামাল।।

কবিতার মূভভাব: 
কবিতাটির মূলভাব হলো মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও প্রীতি, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, নবজীবনের নিরন্তর প্রবাহ এবং সামাজিক ঐক্য ও মানব-সেবার মাধ্যমে এক আশাবাদী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা। সূর্যের ঝলমলে আলোয় এবং স্নিগ্ধ শরৎ প্রকৃতির পটভূমিতে কবি তাঁর দেশের মাটির সঙ্গে প্রাণের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন অনুভব করেন, যেখানে তাঁর জীবনে প্রতি মুহূর্তে নতুন আশা ও প্রেরণা জন্ম নেয়। তিনি প্রকৃতির উর্বরতা ও জীবনের অদম্য স্পন্দনে (যেমন নতুন চর বা নব অঙ্কুর জাগা) এক গৌরবময় জীবনের সন্ধান পান, যা দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতিকে প্রতিফলিত করে। নদী যেমন সাগরে মেশে, তেমনি মানুষে মানুষে মিলে গিয়ে তারা এক মুক্ত-উদার জাতিসত্তা তৈরি করে, যারা দুঃখী (আর্ত-ব্যথিত), জ্ঞানী ও গুণীজনদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা, সাম্য ও ভালোবাসা বিনিময় করে। এই প্রেমময় বন্ধন ও সামাজিক দায়িত্ববোধের মাধ্যমে কবি ঘোষণা করেন যে তাঁর দেশের মাটি ও ভাষা যেমন মধুর, তেমনই তাঁর দেশের মানুষেরা জীবনের নতুন আশ্বাসে প্রতিদিন নতুন করে হেসে ওঠে।

--- পতিতপাবন মণ্ডল (পাবন) 
বাংলা বিভাগীয় প্রধান
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ 


১.
সূর্য-বালকে! মৌসুমী ফুল ফুটে
স্নিগ্ধ শরৎ আকাশের ছায়া লুটে
পড়ে মাঠভরা ধান্য শীর্ষ পরে
দেশের মাটিতে মানুষের ঘরে ঘরে।
আমার দেশের মাটিতে আমার প্রাণ
নীতি লভে নব জীবনের সন্ধান
এখানে প্লাবনে নূহের কিশতি ভাসে
শান্তি-কপোত বারতা লইয়া আসে।
জেগেছে নতুন চর -
সেই চরে ফের মানুষেরা সব পাশাপাশি বাঁধে ঘর।
নব অঙ্কুর জাগে-
প্রতি দিবসের সূর্য-আলোকে অন্তর অনুরাগে
আমার দেশের মাটিতে মেশানো আমার প্রাণের ঘ্রাণ
গৌরবময় জীবনের সম্মান।
প্রাণ-স্পন্দনে লক্ষ ত্বর করে
জীবনপ্রবাহ সঞ্চারির মর্মে
বক্ষে জাগায়ে আগামী দিনের আশা
আমার দেশের এ মাটি মধুর, মধুর আমার ভাষা।

নদীতে নদীতে মিলে হেথা গিয়া যায় সাগরের পানে
মানুষে মানুষে মিলে গিয়া প্রাণে প্রাণে
সূর্য চন্দ্র করে
মৌসুমী ফুলে অঞ্জলি ভরে ভরে
আপন দেশের মাটিতে দাঁড়ায়ে হাসে
সূর্য-বালকে! জীবনের ডাক আসে
সেই ডাকে দেয় সাড়া
নদী-প্রান্তর পার হয়ে আসে লক্ষ প্রাণের ধারা
মিলিতে সবার সনে
আমার দেশের মানুষেরা সবে মুক্ত-উদার মনে
আর্ত-ব্যথিত সুধী গুঞ্জন পাশে
সেবা-সাম্য-প্রীতি বিনিময় আসে
সূর্য-আলোকে আবার এদেশে হাসে
নীতি নবরূপে ভরে উঠে মন জীবনের আশ্বাসে।


শব্দার্থ ও টীকা :
সূর্য-বালকে- সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত, উদ্ভাসিত।
মৌসুমী ফুল- বিশেষ ঋতুতে (সময়ে) উৎপন্ন ফুল।
স্নিগ্ধ শরৎ- শরৎকালের উজ্জ্বলতা।
ধান্য শীর্ষ- ধানের ওপর ভাগ।
নূহের কিশতি- সেমিটিক পুরাণ অনুসারে পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের সময়ে একজন নবির যে বড় নৌকা সবাইকে রক্ষা করেছিল।
শান্তি-কপোত- শান্তির কবুুতর, কবুুতরকে শান্তির প্রতীক বলা হয়।
বারতা- সংবাদ, বার্তা।


পাঠপরিচিতি: সুফিয়া কামালের উন্নত পৃথিবী কাব্যের ‘আমার দেশ’ কবিতাটি ‘সুফিয়া কামাল রচনাসম্ভার’ থেকে সংকলন করা হয়েছে। বাঙালির সোনার বাংলা অসম্ভবকে সম্ভব করে, মাটি থেকে জন্ম দেয় সোনালি ফসল। চমৎকার এর জলবায়ু- সহনীয় রৌদ্রতাপ, নমনীয় জল-বৃষ্টি। তাই এর মাঠ ভরে ওঠে সোনালি ধানে, সবুজ পাটে, নানা বর্ণের ফলফুলে। এদেশের মানুষ পাশাপাশি ঘর বেঁধে তাই শান্তিতে বাস করে। দুর্যোগও যে আসে না তা নয়। কিন্তু দুর্যোগের সময়ও তা অতিক্রমণ হওয়া মাত্র তারা আবার ঘর বাঁধে পাশাপাশি, থাকে শান্তিতে। বাংলার মানুষের মধুর ভাষা, অপার জীবনানন্দ তাদের নিয়ে যায় সম্প্রীতির মহাসাগরে। আকাশে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি ডাক আসে মিলনের। এদেশের মানুষ পরস্পরের মহামিলনের মধ্যেই প্রত্যহ নতুন হয়ে ওঠে। কবিতায় চিরায়ত বাংলার জীবনবাদী আশাবাদ এভাবে ধরা পড়েছে।

কবিতাটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ: 

প্রথম স্তবক:
সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ঋতুভিত্তিক ফুল ফুটে মনোরম রূপ ধারণ করে।  স্নিগ্ধ শরৎকালের কোমল ছায়া মাঠেভরা ধানের শীষের ওপর পড়ে, তখন এই আনন্দ দেশে মাটির মতো প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।

দ্বিতীয় স্তবক:
আমার দেশের এই মাটিতেই আমার প্রাণের অস্তিত্ব। এখানেই আমার জীবন নতুন নীতি ও পথের সন্ধান পায়। যখন প্লাবন বা বন্যার মতো প্রতিকূলতা আসে, তখনও এখানে নূহের কিশতির (আশা ও রক্ষাকর্তা) মতো অবলম্বন ভেসে ওঠে। আর শান্তির দূত কবুতর সব সময় শান্তির বার্তা নিয়ে আসে।

তৃতীয় স্তবক:
এই দেশে নতুন করে চর (পলিমাটি জমে জেগে ওঠা জমি) জেগে ওঠে—সেই নতুন জমিতে মানুষেরা আবার সকলে মিলেমিশে পাশাপাশি ঘর বাঁধে। প্রতিদিনের সূর্যের আলোয় মনের ভালোবাসায় নতুন জীবনের শুরু হয়। আমার দেশের মাটির সঙ্গে আমার প্রাণের ঘ্রাণ বা সুগন্ধ মিশে আছে, যা আমার গৌরবময় জীবনের মর্যাদা ও সম্মান।

চতুর্থ স্তবক:
প্রাণের স্পন্দনের সাথে সাথে লক্ষ্যের দিকে জীবনের ধারা দ্রুত এগিয়ে চলে। এই জীবনপ্রবাহের মূল স্রোতে আগামী দিনের উজ্জ্বল আশা জেগে ওঠে। আমার দেশের মাটি যেমন মিষ্টি, তেমনি মিষ্টি আমার মাতৃভাষা।

পঞ্চম স্তবক:
এদেশের অসংখ্য নদী একে অপরের সাথে মিশে সাগরের দিকে ছুটে চলে। ঠিক তেমনিভাবে এদেশের মানুষও একে অপরের সাথে মন থেকে মিলিত হয়। সূর্য ও চন্দ্রের সাক্ষীতে তারা যেন মৌসুমী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। নিজের দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষ হাসে। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় জীবনের যে আহ্বান আসে, সেই ডাকে তারা সাড়া দেয় এবং দূর-দূরান্তের নদী ও মাঠ পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ একসঙ্গে মিলিত হতে আসে।

ষষ্ঠ স্তবক:
সকলের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য এদেশের মানুষেরা উদার ও মুক্ত মন নিয়ে আসে। দুঃখী ও ব্যথিত মানুষের পাশে এসে তারা সেবা, সমতা ও ভালোবাসার বিনিময় করে। সূর্যের আলোয় এই দেশ আবার হেসে ওঠে এবং জীবনের নতুন আশ্বাসে মানুষের মনে নতুন নীতিবোধ ও আদর্শ জেগে ওঠে।

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.