header ads

তিরন্দাজ ।। যোগীন্দ্রনাথ সরকার।। অষ্টম শ্রেণি।। আনন্দ পাঠ।। ৬টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর।।




১. তিরন্দাজ গল্পের বিষয়বস্তু নিজের ভাষায় লেখো।

যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘তিরন্দাজ’ গল্পটি মূলত মহাভারতের আদিপর্বের একটি অংশবিশেষ, যা কৌরব ও পাণ্ডব রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা এবং তাদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গল্পের সূচনা হয় হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর বংশপরিচয়ের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে তাঁর বংশধর—ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র কৌরব ও পাণ্ডুর পুত্র পাণ্ডবদের মধ্যেকার সম্পর্কের চিত্র ফুটে ওঠে। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে কৌরবদের মনে, বিশেষ করে দুর্যোধনের মনে, পাণ্ডবদের প্রতি হিংসার জন্ম হয়।

গল্পের মূল অংশে প্রবেশ করেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। পিতামহ ভীষ্ম রাজকুমারদের যথার্থ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দ্রোণাচার্যের ওপর তাদের অস্ত্রশিক্ষার ভার অর্পণ করেন। দ্রোণাচার্য সকল শিষ্যকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে শিক্ষা দিলেও পাণ্ডব ভ্রাতাদের মধ্যে তৃতীয়, অর্জুনের একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও গুরুভক্তি তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। গল্পকার বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। যেমন, পাখি শিকারের পরীক্ষায় অন্য সকলে যখন লক্ষ্যবস্তু ছাড়া পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছিল, অর্জুন তখন শুধুমাত্র পাখির মাথাকেই তাঁর লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছিলেন। আবার, কুমিরের আক্রমণ থেকে গুরুকে রক্ষা করার ঘটনায় অর্জুনের সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।

গল্পের শেষে একটি জমকালো রণকৌশল প্রদর্শনী আয়োজিত হয়, যেখানে সকল রাজকুমার নিজ নিজ দক্ষতা প্রদর্শন করে। ভীম ও দুর্যোধন গদাযুদ্ধে পারদর্শিতা দেখালেও অর্জুনের তিরন্দাজির কৌশল সকলকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। অগ্নিবাণ, বরুণবাণ, মেঘ ও পর্বত সৃষ্টি এবং নিজেকে অদৃশ্য করার মতো আশ্চর্য সব কৌশল প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে অদ্বিতীয় প্রমাণ করেন এবং চারিদিক তাঁর জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। বস্তুত, গল্পটি একদিকে যেমন কৌরব-পাণ্ডবের দ্বন্দ্বের সূচনাকে তুলে ধরে, তেমনই অন্যদিকে আগ্রহ, কঠোর অনুশীলন এবং গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি একজনকে যে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে, সেই শাশ্বত সত্যকেও প্রতিষ্ঠা করে।

২. তিরন্দাজ গল্প অবলম্বনে অর্জুন চরিত্রটি বর্ণনা করো।

"তিরন্দাজ" গল্পে অর্জুন কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং তাঁর চরিত্রটি একজন আদর্শ শিষ্যের প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি ছিলেন পাণ্ডু ও কুন্তীর তৃতীয় পুত্র এবং পাণ্ডবদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান তিরন্দাজ।

অর্জুনের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর অসাধারণ একাগ্রতা ও লক্ষ্যস্থিরতা। দ্রোণাচার্য যখন সকল শিষ্যকে একটি কৃত্রিম পাখির মাথা লক্ষ্যভেদ করার পরীক্ষা নেন, তখন একমাত্র অর্জুনই অন্য কোনো দিকে মনোযোগ না দিয়ে শুধু লক্ষ্যবস্তুটি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর উত্তর, "আমি শুধু পাখির মাথা দেখিতেছি, আর কিছুই না," তাঁর গভীর মনোযোগের পরিচায়ক। এই অবিচল মনোযোগই তাঁকে শ্রেষ্ঠ তিরন্দাজে পরিণত করেছিল।

তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো গুরুভক্তি ও আনুগত্য। দ্রোণাচার্য যখন শিষ্যদের কাছে তাঁর একটি কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন, তখন অন্য সকলে চুপ থাকলেও একমাত্র অর্জুনই নির্দ্বিধায় বলেছিলেন যে তিনি গুরুর আদেশ কখনো অমান্য করবেন না। এই আনুগত্য ও শ্রদ্ধা তাঁকে গুরুর প্রিয়পাত্র করে তোলে।

অর্জুন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণ। যখন দ্রোণাচার্য কুমির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিনয় করছিলেন, তখন অন্য রাজকুমাররা ভয় পেয়ে গেলেও অর্জুন নির্ভীকভাবে এগিয়ে এসে বাণের আঘাতে কুমিরটিকে খণ্ড খণ্ড করে গুরুকে রক্ষা করেন। এই ঘটনা তাঁর বীরত্ব ও উপস্থিত বুদ্ধির প্রমাণ দেয়।

পরিশেষে, রণকৌশল প্রদর্শনীতে অর্জুনের দক্ষতা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। অগ্নিবাণ, বরুণবাণ, মেঘসৃষ্টি এবং অদৃশ্য হওয়ার মতো অলৌকিক সব কৌশল প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি তাঁর অর্জিত বিদ্যার সার্থক প্রয়োগ ঘটান। তাঁর এই অসাধারণ প্রতিভা ও গুণাবলি কেবল দর্শকদেরই মুগ্ধ করেনি, বরং হিংসাপরায়ণ দুর্যোধন ও কর্ণের ঈর্ষার কারণও হয়েছিল। সব মিলিয়ে, অর্জুনের চরিত্রটি একাগ্রতা, গুরুভক্তি, সাহস ও অনুশীলনের মাধ্যমে সাফল্যের চূড়ায় আরোহণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

৩. তিরন্দাজ গল্প অবলম্বনে দ্রোণাচার্য চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

যোগীন্দ্রনাথ সরকারের "তিরন্দাজ" গল্পে দ্রোণাচার্য কেবল একজন অস্ত্রশিক্ষক নন, বরং তিনি একজন বিচক্ষণ গুরু এবং আদর্শ ও প্রতিভাবান শিষ্যের যথার্থ মূল্যায়নকারী। মহাভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি ভরদ্বাজ মুনির পুত্র এবং কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু হিসেবে পরিচিত।

দ্রোণাচার্যের চরিত্রের প্রধান দিক হলো তাঁর শিক্ষাদানের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি রাজকুমারদের যুদ্ধবিদ্যায় এমনভাবে পারদর্শী করে তোলার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যা "লোকের তাক লাগিয়া যাইবে"। তাঁর শিক্ষাপদ্ধতি ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও বাস্তবসম্মত। তিনি কেবল পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ না থেকে হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে শিষ্যদের যোগ্যতা যাচাই করতেন। তাঁর কুয়া থেকে শরবিদ্ধ করে লোহার গোলা তুলে আনার ঘটনাটি তাঁর নিজেরই অসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক, যা রাজকুমারদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

দ্রোণাচার্য ছিলেন একজন বিচক্ষণ পরীক্ষক। তিনি শিষ্যদের মনোযোগ, সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন। নীল পাখির মাথা লক্ষ্যভেদের পরীক্ষাটি ছিল মূলত শিষ্যদের একাগ্রতা যাচাইয়ের একটি উপায়। একইভাবে, কুমির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিনয় করে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে সংকটের মুহূর্তে কোন শিষ্য বিপদ থেকে গুরুকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে তিনি শুধু শিষ্যদের অস্ত্রচালনার দক্ষতা নয়, তাদের মানসিক দৃঢ়তাও পরিমাপ করতেন।

দ্রোণাচার্য ছিলেন গুণগ্রাহী এবং স্নেহার্দ্র। তিনি অর্জুনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপার সম্ভাবনাকে শুরুতেই চিনতে পেরেছিলেন। অর্জুনের গুরুভক্তি, একাগ্রতা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন এবং বিশেষ কিছু কৌশল শিখিয়েছিলেন। অর্জুনের প্রতি তাঁর এই পক্ষপাতিত্ব কোনো অন্যায্য কারণে ছিল না, বরং তা ছিল যোগ্য শিষ্যের প্রতি যোগ্য গুরুর স্বাভাবিক স্নেহ ও স্বীকৃতি। অর্জুনের সাফল্যে তিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন এবং তাঁকে 'ব্রহ্মশিরা' নামক ভয়ংকর অস্ত্রটি পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিলেন, যা তাঁর গভীর স্নেহেরই বহিঃপ্রকাশ।

তবে তাঁর চরিত্রে একটি প্রতিশোধের স্পৃহাও লক্ষ্য করা যায়, যখন তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে শিষ্যদের ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।[8] যদিও এই গল্পে সেই দিকটি প্রধান নয়, এটি তাঁর চরিত্রের একটি জটিল দিককে তুলে ধরে। সব মিলিয়ে, দ্রোণাচার্য একজন কঠোর, স্নেহপ্রবণ, বিচক্ষণ এবং কিছুটা জটিল মানসিকতার শিক্ষক, যিনি যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানতেন।

৪. আগ্রহ, চর্চা, নিষ্ঠা ও গুরুভক্তি মানুষকে যেকোনো কঠিন কাজে পারদর্শী করে তুলতে পারে। মন্তব্যটি ‘তিরন্দাজ’ গল্প অবলম্বনে বিশ্লেষণ করো।

"তিরন্দাজ" গল্পে লেখক যোগীন্দ্রনাথ সরকার এই শাশ্বত সত্যটিই প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, যেকোনো কঠিন বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য প্রতিভা বা বংশপরিচয়ের চেয়েও বেশি প্রয়োজন আগ্রহ, নিরন্তর চর্চা, অবিচল নিষ্ঠা এবং গুরুর প্রতি গভীর ভক্তি। গল্পের প্রধান চরিত্র অর্জুনের সাফল্যের মাধ্যমে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

অর্জুনের মধ্যে অস্ত্রবিদ্যার প্রতি ছিল অদম্য আগ্রহ। গুরু দ্রোণাচার্য যখন সকল শিষ্যকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন অর্জুনের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। এই আগ্রহই তাঁকে কঠোর অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

গল্পে অর্জুনের নিরন্তর চর্চার বিষয়টি তাঁর দক্ষতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ধনুর্বিদ্যায় তিনি যে অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলেন, তা একদিনে সম্ভব হয়নি। এর পেছনে ছিল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনুশীলন। দ্রোণাচার্যের নির্দেশিত প্রতিটি কৌশল তিনি বারবার চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করেছিলেন, যা তাঁকে অন্যদের থেকে এগিয়ে দিয়েছিল।

নিষ্ঠা বা একাগ্রতা ছিল অর্জুনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পাখির চোখ বিদ্ধ করার পরীক্ষায় যখন অন্য রাজকুমাররা তাদের মনোযোগ নানা দিকে বিক্ষিপ্ত করেছিল, অর্জুন তখন কেবল লক্ষ্যবস্তুর ওপর তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। এই অবিচল নিষ্ঠাই তাঁকে নির্ভুল লক্ষ্যভেদে সাহায্য করেছিল। এটি প্রমাণ করে যে, পারিপার্শ্বিক কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে লক্ষ্যের প্রতি স্থির থাকতে পারা সফলতার অন্যতম শর্ত।

সর্বোপরি, গুরুভক্তি অর্জুনের চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে। দ্রোণাচার্যের প্রতিটি কথা তিনি বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিতেন। গুরুর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছিল। যখন দ্রোণাচার্য তাঁর একটি কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন, অর্জুন নির্দ্বিধায় সম্মতি জানিয়েছিলেন। আবার, কুমিরের আক্রমণ থেকে গুরুকে রক্ষা করার মধ্য দিয়েও তাঁর গুরুভক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এই গুরুভক্তির কারণেই দ্রোণাচার্য তাঁকে উজাড় করে তাঁর শ্রেষ্ঠ বিদ্যা দান করেছিলেন এবং অর্জুনও তা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সুতরাং, কৌরবদের তুলনায় পাণ্ডবরা সংখ্যায় কম হলেও বা দুর্যোধনের মতো রাজকীয় অহংকার না থাকলেও, অর্জুন কেবল আগ্রহ, চর্চা, নিষ্ঠা ও গুরুভক্তির সমন্বয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ তিরন্দাজ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। গল্পটি এই শিক্ষাই দেয় যে, এই চারটি গুণের অধিকারী হলে যেকোনো মানুষই নিজ ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে।

৫. গুরু দ্রোণাচার্য কেন বারবার তার শিষ্যদের পরীক্ষা করতে থাকেন ‘তিরন্দাজ’ গল্প অবলম্বনে বর্ণনা করো।

‘তিরন্দাজ’ গল্পে গুরু দ্রোণাচার্যকে কেবল একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন বিচক্ষণ পরীক্ষক হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বারবার তাঁর শিষ্যদের পরীক্ষা করতেন, কারণ তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন যে, তারা অস্ত্রচালনার কলাকৌশল কতটা আয়ত্ত করতে পেরেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত। 

দ্রোণাচার্য জানতেন, যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যস্থির থাকা এবং মনোযোগ অটুট রাখা সবচেয়ে জরুরি। এই গুণটি যাচাই করার জন্যই তিনি গাছে একটি কৃত্রিম পাখি রেখে তার মাথা লক্ষ্যভেদ করার পরীক্ষাটির আয়োজন করেন। কে কী দেখছে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন কোন শিষ্যের মনোযোগ কেবল লক্ষ্যের ওপর নিবদ্ধ আছে। যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধনের মতো শিষ্যরা যখন গাছ, ডালপালা এবং অন্যান্য জিনিস দেখার কথা বলে, তখন দ্রোণাচার্য বুঝতে পারেন যে তাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত। কিন্তু অর্জুনের উত্তর ("আমি শুধু পাখির মাথা দেখিতেছি") প্রমাণ করে যে, তাঁর একাগ্রতা সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি শিষ্যদের মানসিক স্থিরতা পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু অস্ত্রের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সাহস এবং সংকটময় মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। এই গুণগুলো পরীক্ষা করার জন্যই দ্রোণাচার্য কুমির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিনয় করেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, আকস্মিক বিপদে শিষ্যরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, নাকি冷静 মাথায় গুরুকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। অন্য রাজকুমাররা যখন ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছিল, তখন অর্জুন নির্ভীকভাবে এগিয়ে এসে তাঁর অর্জিত বিদ্যার সঠিক প্রয়োগ করে গুরুকে "রক্ষা" করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রোণাচার্য শিষ্যদের ব্যবহারিক জ্ঞান এবং মানসিক দৃঢ়তা যাচাই করেছিলেন।

দ্রোণাচার্যের লক্ষ্য ছিল তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কে কোন অস্ত্রে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, তা নিরূপণ করা। প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি বুঝতে পারতেন কার কতটা উন্নতি হয়েছে। অর্জুন যে ধনুর্বিদ্যায় অদ্বিতীয়, ভীম ও দুর্যোধন যে গদাযুদ্ধে পারদর্শী, তা এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়। তিনি যোগ্যতম শিষ্যকে খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন, যাকে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র—'ব্রহ্মশিরা'—দান করতে পারেন।

সুতরাং, দ্রোণাচার্যের পরীক্ষাগুলো কেবল শিষ্যদের পারদর্শিতা মাপার উপায় ছিল না, বরং এগুলো ছিল তাদের মানসিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা গঠনের একটি প্রক্রিয়া। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যরা শুধু যোদ্ধা নয়, বরং যেকোনো পরিস্থিতিতে অবিচল থাকার মতো মানসিক শক্তির অধিকারী হোক।

৬. `গুরু দ্রোণাচার্য অর্জুনকে অধিক ভালবাসতেন।'-মন্তব্যটির সত্যতা নির্ণয় করো।

গুরু দ্রোণাচার্য অর্জুনকে অধিক ভালবাসতেন"-তিরন্দাজ" গল্পের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এই মন্তব্যটি নিঃসন্দেহে সত্য বলে প্রতীয়মান হয় যে, গুরু দ্রোণাচার্য অন্য সকল শিষ্যের তুলনায় অর্জুনকে অধিক ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। এই ভালোবাসার কারণ কোনো পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ছিল না, বরং তা ছিল অর্জুনের অসাধারণ গুণাবলির প্রতি গুরুর স্বাভাবিক মুগ্ধতা ও স্বীকৃতি।

গল্পে দেখা যায়, দ্রোণাচার্য যখন শিষ্যদের কাছে তাঁর একটি কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চান, তখন অর্জুনই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নির্দ্বিধায় সেই প্রতিশ্রুতি দেন। অর্জুনের এই নিঃশর্ত আনুগত্য দ্রোণাচার্যের হৃদয় স্পর্শ করে এবং সেদিন থেকেই তিনি অর্জুনকে "ঠিক নিজের ছেলের মতো ভালোবাসিতে লাগিলেন"। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, অর্জুনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অর্জনের ফল, অযাচিত পক্ষপাতিত্ব নয়।

পাখির মাথা লক্ষ্যভেদ করার পরীক্ষায় অর্জুনের অসাধারণ মনোযোগ দ্রোণাচার্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যখন অন্য শিষ্যরা ব্যর্থ হয়, তখন অর্জুনের নির্ভুল লক্ষ্যভেদ দেখে দ্রোণাচার্যের "মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল"। একজন শিক্ষক হিসেবে শ্রেষ্ঠ শিষ্যের সাফল্যে তিনি গর্বিত ও আনন্দিত হয়েছিলেন, যা তাঁর ভালোবাসারই প্রকাশ।

দ্রোণাচার্য তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ভয়ংকর অস্ত্র ‘ব্রহ্মশিরা’ একমাত্র অর্জুনকেই পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিলেন। কুমিরের ঘটনায় অর্জুনের সাহস ও কর্তব্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি এই পুরস্কার দেন। একজন গুরু তাঁর শ্রেষ্ঠ জ্ঞান বা অস্ত্র সবচেয়ে যোগ্য ও বিশ্বস্ত শিষ্যকেই দান করেন। এই ঘটনাটি অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের গভীর আস্থা ও ভালোবাসার একটি অকাট্য প্রমাণ।

গল্পে উল্লেখ আছে, দ্রোণাচার্য মনে মনে স্থির করেছিলেন যে, তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে এমন কৌশল শেখাবেন যেন পৃথিবীতে কেউই তাঁর সমকক্ষ হতে না পারে। ("এই প্রিয় শিষ্যটিকে এমন-সকল কৌশল শিখাইব যে, পৃথিবীতে কেহই যেন ইহার সহিত আঁটিয়া উঠিতে না পারে।") এই চিন্তাটিই প্রমাণ করে যে, তিনি অর্জুনের জন্য একটি বিশেষ স্থান সংরক্ষণ করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি তাঁর প্রত্যাশা ছিল সর্বোচ্চ।

তবে এই অধিক ভালোবাসা কৌরব, বিশেষ করে দুর্যোধন ও কর্ণের মনে হিংসার উদ্রেক করেছিল। তারা মনে করত, দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন। কিন্তু গল্পের নিরিখে বলা যায়, অর্জুন তাঁর যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও গুরুভক্তি দিয়েই দ্রোণাচার্যের এই বিশেষ স্নেহ ও ভালোবাসা অর্জন করে নিয়েছিলেন।

পতিতপাবন মণ্ডল (পাবন) 
বাংলা বিভাগীয় প্রধান
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ঢাকা। 




No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.