header ads

কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন।। বাংলা দ্বিতীয় পত্র।। নবম,দশম, একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণি।। ২৩টি পয়েন্টে লেখা একটি অন্যন্য রচনা।।


১. ভূমিকা:
আধুনিক সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে যন্ত্রটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে, তার নাম কম্পিউটার। এটি আজ আর নিছক একটি গণনাকারী যন্ত্র নয়, বরং মানব মস্তিষ্কের এক বর্ধিত সংস্করণ, যা আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করা থেকে শুরু করে রাতের বিশ্রামে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আমরা কম্পিউটারের সুবিশাল জগতে বিচরণ করি। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো এটি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে অকল্পনীয় ক্ষমতা, যা দিয়ে আমরা জয় করছি দেশ, কাল ও দূরত্বের সমস্ত বাধা। একবিংশ শতাব্দীর এই গতিময় জীবনে কম্পিউটার ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করা দুঃসাধ্য।

২. কম্পিউটারের আবিষ্কার ও বিবর্তন:
কম্পিউটারের আজকের যে রূপ আমরা দেখি, তার পেছনে রয়েছে শত বছরের সাধনা ও বিস্ময়কর বিবর্তনের ইতিহাস। চার্লস ব্যাবেজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন ও অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের নকশার মধ্যে যে সম্ভাবনার বীজ রোপিত হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিশাল আকৃতির ঘরজোড়া কম্পিউটার থেকে আজকের হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোন—এই প্রযুক্তিগত উল­ম্ফন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। ট্রানজিস্টর, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) এবং মাইক্রোপ্রসেসরের আবিষ্কার এই বিবর্তনকে দিয়েছে অকল্পনীয় গতি। কম্পিউটার আজ কেবল দ্রুততর ও ক্ষুদ্রতরই হয়নি, বরং হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী।

৩. শিক্ষা ক্ষেত্রে কম্পিউটারের বিপ্লব:
শিক্ষার চিরায়ত প্রাঙ্গণে কম্পিউটার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। চক-ডাস্টারের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্মার্টবোর্ডের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান হয়ে উঠেছে আরও প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয়। করোনা মহামারিকালে অনলাইন ক্লাস ও দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা কোটি কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে সচল রেখেছে। এখন আর দুর্লভ বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না; ই-বুক ও অনলাইন জার্নালের কল্যাণে বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানভান্ডার আমাদের হাতের মুঠোয়। এই প্রযুক্তিগত ছোঁয়ায় শিক্ষা এখন আর চার দেওয়ালে আবদ্ধ নেই, বরং তা হয়ে উঠেছে এক সার্বজনীন ও সহজলভ্য অধিকার।

৪. লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনায় কম্পিউটারের ব্যবহার: 
প্রাচীনকালের পুঁথিপত্র থেকে শুরু করে আধুনিক লাইব্রেরির বইয়ের তাক—সর্বত্রই এখন কম্পিউটারের স্পর্শ। কম্পিউটারাইজড ক্যাটালগিং সিস্টেমের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বইয়ের তথ্য সংরক্ষণ এবং পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট বইটি খুঁজে বের করা এখন কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। বারকোড প্রযুক্তির মাধ্যমে বই আদান-প্রদান প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে নির্ভুল ও দ্রুত। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল লাইব্রেরি বা ই-লাইব্রেরির মাধ্যমে দুর্লভ পাণ্ডুলিপি, প্রাচীন গ্রন্থ এবং গবেষণাপত্রকেও ডিজিটাইজ করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জ্ঞানচর্চার পথ হয়েছে আরও মসৃণ ও প্রশস্ত।

৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন:
একসময়কার চিঠি বা টেলিগ্রামের যুগকে পেছনে ফেলে কম্পিউটার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে এক অভাবনীয় বিপ্লব। মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বার্তা পাঠানোর জন্য রয়েছে ইমেল। ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো ভৌগোলিক দূরত্বকে ঘুচিয়ে দিয়ে মানুষকে এক ভার্চুয়াল সামাজিক বলয়ে আবদ্ধ করেছে। ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে আমরা এখন প্রিয়জনের মুখ দেখে কথা বলতে পারি, দূর থেকেও অনুভব করতে পারি সান্নিধ্যের উষ্ণতা। মার্শাল ম্যাকলুহানের "গ্লোবাল ভিলেজ" বা বৈশ্বিক গ্রামের ধারণাটি আজ কম্পিউটারের কল্যাণে বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

৬. কর্মজীবন ও অফিস ব্যবস্থাপনা: 
আধুনিক অফিস বা কর্মক্ষেত্রের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে কম্পিউটারের কর্মশক্তি। কাগজের ফাইলের পাহাড় সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ডিজিটাল ডেটাবেজ, যা তথ্যের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাকে করেছে সহজ ও নিরাপদ। স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে মানুষ এখন আরও সৃজনশীল ও কৌশলগত কাজে মনোযোগ দিতে পারছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে ‘রিমোট ওয়ার্ক’ বা দূরবর্তী কাজের ধারণাটিও জনপ্রিয় হয়েছে কেবল কম্পিউটারের ওপর ভর করে, যা কর্মীদের দিয়েছে কাজের স্বাধীনতা ও নমনীয়তা।

৭. চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা: 
মানব স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় কম্পিউটার এক অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে। সিটি স্ক্যান, এমআরআই, আলট্রাসনোগ্রাফির মতো জটিল রোগ নির্ণয়কারী যন্ত্রগুলো কম্পিউটারের সাহায্যেই পরিচালিত হয়। রোগীর চিকিৎসার যাবতীয় তথ্য ডিজিটাল হেলথ রেকর্ডে সংরক্ষিত থাকায় যেকোনো সময় চিকিৎসক তা পর্যালোচনা করতে পারেন। দুর্গম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখন টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছেন। জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকে শুরু করে নতুন ঔষধ আবিষ্কার—চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় কম্পিউটার রেখে চলেছে তার অনবদ্য অবদান।

৮. ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি: 
কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ই-কমার্সের বদৌলতে প্রথাগত বাজারের ধারণা বদলে গেছে; ক্রেতারা এখন ঘরে বসেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজেদের পছন্দের পণ্যটি কিনতে পারছেন। অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (যেমন: বিকাশ, নগদ) মানুষের আর্থিক লেনদেনকে করেছে দ্রুত, সহজ ও নিরাপদ। শেয়ারবাজারের জটিল হিসাবনিকাশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সার্বিক ব্যবস্থাপনা—সবকিছুই আজ কম্পিউটার-নির্ভর, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে দিয়েছে অভূতপূর্ব গতি।

৯. বিনোদন জগতে কম্পিউটারের প্রভাব: 
বিনোদনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে কম্পিউটার। উচ্চমানের গ্রাফিক্স সমৃদ্ধ ভিডিও গেম তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে কল্পনার এক নতুন জগতে। স্পেশাল ইফেক্টস (VFX) ও অ্যানিমেশনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে এমন সব দৃশ্য তৈরি করা হচ্ছে, যা আগে ছিল অকল্পনীয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গান শোনা, সিনেমা দেখা কিংবা ওয়েব সিরিজ উপভোগ করা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল আর্ট বা গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের মাধ্যমে শিল্পীরা ক্যানভাসের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে নিজেদের সৃজনশীলতাকে মেলে ধরছেন ডিজিটাল মাধ্যমে।

১০. বিজ্ঞান ও গবেষণা: 
বিজ্ঞান ও গবেষণার জগতে কম্পিউটার এক নীরব সহকর্মী। মহাকাশ গবেষণা, পারমাণবিক শক্তি বা জৌতির্বিদ্যার মতো ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ও জটিল গণনা প্রয়োজন, তা মানুষের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। সুপার কম্পিউটার সেই অসাধ্য সাধন করে চলেছে। আবহাওয়া পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বৃদ্ধি, জিনগত রহস্য উন্মোচন কিংবা নতুন কোনো মৌল আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে কম্পিউটারের শক্তিশালী ডেটা বিশ্লেষণ ক্ষমতা। কম্পিউটার ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণার অগ্রগতি এককথায় অচল।

১১. কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ: 
কৃষির মতো ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্রেও কম্পিউটার নিয়ে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ‘স্মার্ট ফার্মিং’ বা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি। সেন্সরের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ও পুষ্টিগুণ পরিমাপ, ড্রোনের সাহায্যে ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও কীটনাশক প্রয়োগ, এবং স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণ করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া—এ সবকিছুই উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এর ফলে কৃষিকাজ এখন আরও বিজ্ঞানসম্মত ও লাভজনক হয়ে উঠছে।

১২. শিল্পক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার: 
শিল্পকারখানায় উৎপাদনের গতি ও মানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে কম্পিউটার। কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন (CAD) এর মাধ্যমে পণ্যের নিখুঁত নকশা তৈরি করা হচ্ছে এবং কম্পিউটার এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং (CMD) এর মাধ্যমে সেই নকশাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হচ্ছে। রোবটিক্সের ব্যবহারে কারখানার বিপজ্জনক ও পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলো যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অটোমেশন শিল্পবিপ্লবের ধারাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেছে।

১৩. সরকারি পরিষেবা ও ই-গভর্নেন্স: 
সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে কম্পিউটার। ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকরা এখন ঘরে বসেই জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্টের আবেদন, জমির পর্চা সংগ্রহ বা আয়কর প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারছেন। বিভিন্ন সরকারি তথ্য ও সেবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্ত হওয়ায় প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে একদিকে যেমন নাগরিকদের হয়রানি কমেছে, অন্যদিকে সরকারি কাজের গতিও বেড়েছে বহুগুণ।

১৪. সামরিকক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার: 
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র এখন আর কেবল অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি দিয়ে জয় করা যায় না; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির কৌশল। দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় কম্পিউটার এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। শত্র“পক্ষের অবস্থান নির্ণয়ে স্যাটেলাইট ও রাডার সিস্টেম, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন পরিচালনা, মিসাইল উৎক্ষেপণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখতে কম্পিউটার প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। সাইবার যুদ্ধ বা ডিজিটাল রণক্ষেত্রেও কম্পিউটারই প্রধান হাতিয়ার, যা দেশের ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্যবহৃত হয়।

১৫. দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সরলীকরণ: 
কম্পিউটার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে করেছে স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। এখন আর বিদ্যুৎ বা গ্যাসের বিল দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয় না, অনলাইনে কয়েক মিনিটেই তা পরিশোধ করা যায়। বাস, ট্রেন বা বিমানের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে রাইড-শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি ডাকা—সবই সম্ভব হচ্ছে একটি ক্লিকে। অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে শুরু করে শখের বস্তু, সবকিছুই পৌঁছে যাচ্ছে দোরগোড়ায়। এভাবেই কম্পিউটার আমাদের মূল্যবান সময় ও শ্রম বাঁচিয়ে জীবনকে করেছে সহজতর।

১৬. তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জ্ঞানার্জন: 
ইন্টারনেট সংযুক্ত একটি কম্পিউটার যেন জ্ঞানরাজ্যের চাবিকাঠি। গুগল, বিং-এর মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলোর মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ে তথ্য খুঁজে পাওয়া এখন কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষ অথবা বিভিন্ন শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট আমাদের জ্ঞানার্জনের ক্ষুধাকে প্রতিনিয়ত নিবারণ করে চলেছে। তথ্যের এই অবাধ প্রবাহ কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই নয়, বরং স্বশিক্ষাকেও উৎসাহিত করছে। এর ফলে পৃথিবীজুড়ে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আদান-প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৭. কম্পিউটারের নেতিবাচক দিক:
 প্রতিটি মুদ্রার যেমন দুটি পিঠ থাকে, তেমনি কম্পিউটারের আশীর্বাদের পাশাপাশি রয়েছে কিছু অন্ধকার দিকও। প্রযুক্তির এই অসীম শক্তি যখন ভুল পথে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানব সভ্যতার জন্য মারাÍক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সাইবার অপরাধ, সহিংস কন্টেন্টের প্রচার, এবং মিথ্যা তথ্যের বিস্তারের মতো বিষয়গুলো সমাজের স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের পরিবর্তে এর অপপ্রয়োগ আমাদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে, যা এক গভীর উদ্বেগের কারণ।

১৮. স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি:
কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাÍক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখ ও মাথার যন্ত্রণা, ঘাড় ও পিঠের ব্যথা এবং অনিদ্রার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এর পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এবং ভার্চুয়াল জগতের চাপ অনেককে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়। প্রযুক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় না রাখলে এই স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

১৯. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা:

কম্পিউটার আমাদের বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত করলেও পাশের মানুষটির থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতের রঙিন হাতছানিতে আমরা বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছি। পরিবারের সদস্যরা এক ছাদের নিচে থেকেও নিজেদের স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকছেন, বন্ধুদের আড্ডায় এখন আর আগের মতো প্রাণ নেই। এই পৎবংপবহঃব সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষের আবেগীয় ও মানসিক বিকাশের পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অশনিসংকেত।

২০. সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা: 
ডিজিটাল জগতে আমাদের পদচারণা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে সাইবার অপরাধের ঝুঁকি। হ্যাকাররা প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত তথ্য, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং গোপনীয় নথি চুরির চেষ্টা করছে। অনলাইন প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ। এছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া পরিচয় তৈরি করে হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং এবং গুজব ছড়ানোর মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। এই অদৃশ্য শত্র“র মোকাবিলা করা এবং ডিজিটাল জগতে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আজ এক বড় চ্যালেঞ্জ।

২১. কর্মসংস্থান হ্রাস: 
কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিকে যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি তৈরি করছে। কলকারখানা, ব্যাংক, কিংবা ডেটা এন্ট্রি-এর মতো অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্র মানুষের কাজ দখল করে নিচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন নতুন দক্ষতা অর্জন এবং পরিবর্তিত কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা।

২২. ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)
কম্পিউটার প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আরও বিস্ময়কর ও সম্ভাবনাময়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) মানুষের মতোই চিন্তা করতে ও শিখতে শুরু করেছে, যা স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় যানবাহন পর্যন্ত সবকিছুকে বদলে দেবে। ইন্টারনেট অফ থিংস (IOT) আমাদের ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে শহরের পরিকাঠামো পর্যন্ত সবকিছুকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করবে। আর কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের অপার শক্তি হয়তো এমন সব সমস্যার সমাধান করবে, যা আজ আমাদের কল্পনারও অতীত।

২৩. উপসংহার: কম্পিউটারের সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণ সাধন পরিশেষে বলা যায়, কম্পিউটার একাধারে আশীর্বাদ ও অভিশাপ—এর ব্যবহারই নির্ধারণ করে এর স্বরূপ। এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা মানবজাতির অশেষ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আবার এর লাগামহীন ও বিবেকহীন ব্যবহার ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। তাই, আমাদের দায়িত্ব হলো কম্পিউটারের ইতিবাচক দিকগুলোকে গ্রহণ করে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা। প্রযুক্তির দাসে পরিণত না হয়ে তাকে মানব কল্যাণের সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করতে পারলেই আধুনিক জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে উঠবে।

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.