পুরুষের নারীলোভ : ভ্রান্তি ও ভ্রান্তিহীনতা
ভূমিকা:
কেউ যদি হঠাৎ বলে ওঠেন—“পুরুষের নারীলোভ থাকাটা দরকার”—শুনেই আপনার কপালে শিরা দপদপ করে উঠবে, এতে আশ্চর্য কিছু নেই। কারণ, সমাজ আমাদের কানে এমন কথাকে অশ্লীল, বিকৃত কিংবা লম্পটতার সমার্থক করে দিয়েছে। তবু একটু থামুন, ধৈর্য ধরুন, তর্কে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শোনার চেষ্টা করুন। কারণ প্রবন্ধকারের কাজই তো সেই অস্বস্তিকর সত্যের দিকে আঙুল তোলা, যাকে আমরা সভ্যতার মোড়কে আড়াল করতে চাই।
অধ্যায় এক : প্রকৃতির আদিম ডাক
ভাবুন তো, এমন এক পৃথিবী, যেখানে পুরুষের নারীদেহের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই।
নারীর চোখ, হাসি, শরীর—কিছুই তাকে টানে না।
তাহলে কী ঘটত?
একজন পাঠক এ-প্রশ্ন শুনে হয়তো বলবেন—
“খুব ভালোই তো! তাহলে পুরুষ আত্মকেন্দ্রিক হতো, নারীরা থাকত মুক্ত।”
কিন্তু প্রিয় পাঠক, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানই তখন জন্ম নিত না। পুরুষ কীসের জন্য নারীর পাশে দাঁড়াত? কেন বা তার কষ্টার্জিত শ্রম একজন নারীর জন্য ব্যয় করত? সন্তান জন্মাত যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, কিন্তু ‘বাবা’ শব্দটির আবেগ হারিয়ে যেত।
সত্যিটা হলো—নারীদেহের প্রতি পুরুষের এই অপ্রতিরোধ্য টানই সভ্যতার প্রথম পাঠশালা। সেই আকর্ষণই তাকে যাযাবর থেকে সংসারী করেছে, শিকারি থেকে কৃষক করেছে। যে শক্তিকে আমরা ‘লোভ’ বলে গালি দিই, তা আসলে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রাকৃতিক অমোঘ অস্ত্র।
অধ্যায় দুই : লোভ থেকে ভালোবাসা
এবার প্রশ্ন—প্রেম কি কেবল মানসিক?
—“প্রেম তো হৃদয়ের ব্যাপার, শরীরের নয়।”
—“ভাই, আপনি ভীষণ ভণ্ড বা ভীষণ সরল। প্রেম হলো শরীর ও মনের যৌথ রসায়ন।”
একটি হাসি, একটি চাহনি, একটি হাঁটার ভঙ্গি—এসব দিয়েই যে প্রেমের ঢেউ ওঠে, তার নামই প্রথমে কামনা। কিন্তু এখানেই থেমে যায় না। এক বুদ্ধিমান পুরুষ তার প্রেয়সীর ভেতরের মানুষটিকে আবিষ্কার করে। ধীরে ধীরে সেই কামনা রূপ নেয় যত্নে, দায়বদ্ধতায়, গভীর প্রেমে।
যে আকর্ষণকে আমরা ‘লোভ’ বলে দোষারোপ করি, সেটাই আসলে ভালোবাসার প্রথম সিঁড়ি। যেমন লবণ ছাড়া তরকারি নিস্বাদ, তেমনি আকর্ষণহীন সম্পর্কও নির্জীব।
অধ্যায় তিন : নারী বনাম পুরুষ—আকাঙ্ক্ষার দুই মেরু
সমাজ পুরুষের নারীলোভকে দোষ দেয়, কিন্তু নারীর প্রেমলোভকে মহিমান্বিত করে।
এ কি ভণ্ডামি নয়?
নারীর চাহিদা হলো ভালোবাসা, যত্ন, আদর, মনোযোগ। চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়া, কপালে একটি চুম্বন, শক্ত করে জড়িয়ে ধরা—এগুলোই তার কাছে মহার্ঘ। সে ‘প্রেম-লোভী’।
অন্যদিকে পুরুষ ‘দেহ-লোভী’। তার আকাঙ্ক্ষা সরাসরি ও শারীরিক। নারী মন দিয়ে জয় করতে চায়, পুরুষ শরীর দিয়ে মন জয় করতে চায়। দুটোই প্রকৃতিগত, অপরাধ নয়। অপরাধ তখনই, যখন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে।
অধ্যায় চার : নিয়ন্ত্রণের খেলা
আগুন রান্না করে, আবার ঘর জ্বালিয়েও দেয়।
পুরুষের কামনাও তাই।
একজন বুদ্ধিমান পুরুষ জানে—নারীর প্রতি তার আকর্ষণ স্বাভাবিক। সে সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করে, সঙ্গিনীর জন্য উজাড় করে দেয়। তার আকর্ষণ হয়ে ওঠে উষ্ণ, সম্মানমিশ্রিত।
কিন্তু যে পুরুষ কামনার দাস, তার চোখে নারী শুধু ভোগের বস্তু। সেই অনিয়ন্ত্রিত কামনাই ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির জন্ম দেয়। তাই পার্থক্যটা ‘লোভে’ নয়, পার্থক্যটা নিয়ন্ত্রণে।
অধ্যায় পাঁচ : বিশ্বাসঘাতকতার অন্তরালে
কেন সম্পর্ক ভাঙে?
একজন পাঠক বললেন—
“নারী তো লোভে পড়ে যায়।”
আরেকজন প্রতিবাদ করলেন—
“না, পুরুষই বেশি বিশ্বাসঘাতক।”
কিন্তু ভেতরের সত্য হলো—নারী তার মানসিক ক্ষুধা না পেলে অন্য কারও কাছে যায়। পুরুষ তার দেহী ক্ষুধা না মিটলে ভিন্ন আশ্রয় খোঁজে।
অতএব, প্রতারণা আসলে অপূর্ণ চাহিদার বহিঃপ্রকাশ।
উপসংহার: সত্যকে স্বীকারের সাহস পুরুষের নারীলোভ প্রকৃতির নিয়ম। অস্বীকার নয়, নিয়ন্ত্রণই সমাধান। নারী যেমন আদর-যত্নের ক্ষুধার্ত, পুরুষ তেমনি দেহী উষ্ণতার তৃষ্ণার্ত। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দু’পক্ষকেই একে অপরের প্রকৃতিগত চাহিদাকে সম্মান করতে হবে। একজন প্রকৃত পুরুষ সেই, যে তার ভেতরের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করে কেবল সঙ্গিনীর জন্য জ্বালিয়ে রাখে। আর প্রকৃত প্রেমিকা সেই, যে নিজের ভালোবাসা দিয়ে সেই আগুনকে শুদ্ধ রাখে। তাহলে বলুন, পাঠক—আপনার রাগ এখনো কি অটুট? নাকি চিন্তার দেওয়ালে সামান্যতম চিড় ধরেছে?
পতিতপাবন মণ্ডল
No comments
Thank you, best of luck