বাংলাদেশ থেকে ভারতের মেডিকেল ভিসা প্রক্রিয়া: চিকিৎসার জন্য বাড়ছে আবেদন, কীভাবে মিলবে সহজে অনুমোদন
বাংলাদেশের হাজারো মানুষ প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য ছুটে যান ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে। প্রতিবেশী এই দেশটির বিশ্বমানের হাসপাতাল, অভিজ্ঞ ডাক্তার, তুলনামূলক সাশ্রয়ী চিকিৎসা খরচ এবং ভাষাগত মিলের কারণে ভারত বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে চিকিৎসার অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভিসা— ইন্ডিয়ান মেডিকেল ভিসা।
২০২৫ সালে এসে এই ভিসা পাওয়ার নিয়মকানুন কিছুটা হালনাগাদ হয়েছে। আবেদন প্রক্রিয়া এখন সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক হলেও অনেকেই নিয়মকানুন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় সমস্যায় পড়েন। ফলে অনেক সময় আবেদনকারীর ভিসা বিলম্বিত হয় কিংবা বাতিল হয়ে যায়।
এই প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে— বাংলাদেশ থেকে কীভাবে সঠিকভাবে ইন্ডিয়ান মেডিকেল ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে, কী কী কাগজপত্র লাগবে, কত সময় লাগে, খরচ কত, এবং আবেদন প্রক্রিয়ায় সাধারণত কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
কেন ভারত বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য প্রধান গন্তব্য?
বাংলাদেশে জটিল রোগ যেমন— ক্যান্সার, হার্টের সমস্যা, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, নিউরোসার্জারি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন ইত্যাদির উন্নত চিকিৎসা সবসময় সহজলভ্য নয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ সারি, আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা অনেক সময় সাধারণ নাগরিকের নাগালের বাইরে।
অন্যদিকে ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু কিংবা ভেলোর শহরে অবস্থিত হাসপাতালগুলোতে তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে রয়েছে সহজ যাতায়াত সুবিধা, ভাষাগত সাদৃশ্য এবং আত্মীয়-পরিজনের সহযোগিতা।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম (৫৬), যিনি সম্প্রতি দিল্লিতে হৃদযন্ত্রের অপারেশন করিয়েছেন, তিনি বলেন—
“বাংলাদেশে ডাক্তাররা বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভারতে খরচ তুলনামূলক কম পড়েছে, আর সেবা পেয়েছি যথেষ্ট ভালো। ভিসা করতে একটু ঝামেলা হলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি।”
মেডিকেল ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
২০২৫ সালে ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী মেডিকেল ভিসার জন্য আবেদনের সময় নিম্নোক্ত ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে—
রোগীর আসল পাসপোর্ট ও ফটোকপি (কমপক্ষে ৬ মাসের মেয়াদ থাকতে হবে)।
অ্যাটেনডেন্টের পাসপোর্ট ও ফটোকপি (সর্বোচ্চ ২ জন যেতে পারেন)।
২ কপি সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজ ছবি (সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে)।
জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা জন্মসনদ।
বর্তমান ঠিকানার প্রমাণপত্র (যেমন: বিদ্যুৎ বিল বা গ্যাস বিলের কপি)।
ভারতের হাসপাতাল কর্তৃক ইস্যুকৃত আমন্ত্রণপত্র (Invitation Letter), যেখানে রোগীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, চিকিৎসার ধরণ এবং সম্ভাব্য সময়কাল উল্লেখ থাকবে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল একটি অনলাইন রেফারেন্স নম্বরও প্রদান করে।
স্থানীয় ডাক্তারের রেফারেন্স বা প্রেসক্রিপশন।
ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ (যদি প্রাসঙ্গিক হয়)।
পূর্ববর্তী ভারতীয় ভিসা (যদি থাকে)।
টিকিট ও হোটেল বুকিং (মেডিকেল ভিসার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবে ট্যুরিস্ট ভিসার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়)।
আবেদন প্রক্রিয়া: ধাপে ধাপে
ধাপ ১: অনলাইনে ফর্ম পূরণ
ওয়েবসাইটে গিয়ে ভিসার ধরন নির্বাচন করতে হয়। মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য যেমন— চিকিৎসার কারণ, হাসপাতালের নাম ও ঠিকানা, এবং চিকিৎসকের নাম দিতে হয়।
ধাপ ২: প্রিন্ট ও সাক্ষর
ফর্ম পূরণ শেষে সেটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করতে হয়। আবেদনকারী ও অ্যাটেনডেন্টদের নির্দিষ্ট স্থানে স্বাক্ষর করতে হয়।
ধাপ ৩: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ
ফর্মের সঙ্গে সমস্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (যেমন আমন্ত্রণপত্র, পাসপোর্ট, ছবি ইত্যাদি) সংযুক্ত করতে হয়।
ধাপ ৪: ভিসা সেন্টারে জমা
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন ভিসা আবেদন কেন্দ্রে (IVAC) কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সেখানে বায়োমেট্রিকস সম্পন্ন করা হয়।
ধাপ ৫: VFS অ্যাপয়েন্টমেন্ট
বর্তমানে সব আবেদনকারীকেই VFS (Visa Facilitation Services) সেন্টারের মাধ্যমে কাগজপত্র জমা দিতে হয়। অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নির্ধারিত দিনে উপস্থিত থাকতে হয়।
প্রসেসিং সময় ও ফি
সাধারণত ৫–৭ কার্যদিবসের মধ্যে ভিসা ইস্যু হয়। তবে জটিল কেসে বা কাগজপত্র অসম্পূর্ণ হলে সময় আরও বেশি লাগতে পারে।
মেডিকেল ভিসার জন্য সরাসরি কোনো ফি নেওয়া হয় না। তবে VFS প্রসেসিং ফি হিসেবে কিছু টাকা জমা দিতে হয়।
কিছু ক্ষেত্রে এক্সপ্রেস সার্ভিসও পাওয়া যায়, যেখানে অতিরিক্ত ফি দিয়ে দ্রুত ভিসা পাওয়া সম্ভব।
নাগরিকদের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লাখো মানুষ ভারতে যান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন।
ঢাকার বাসিন্দা রোকসানা আক্তার (৪২), যিনি কলকাতায় কিডনি চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন, তিনি বলেন—
“আমন্ত্রণপত্র পাওয়াটা একটু সময়সাপেক্ষ। হাসপাতালের সাথে বারবার যোগাযোগ করতে হয়েছে। তবে ভিসার কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর ৬ দিনের মধ্যেই পেয়ে গেছি।”
অন্যদিকে মফস্বল এলাকার অনেক মানুষ তথ্য না জানার কারণে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় দালালের কাছে নির্ভরশীল হন। এতে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ভ্রমণ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান—
“ভারতে চিকিৎসার জন্য ভিসা প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ করা হয়েছে। তবে কাগজপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত না করলে আবেদনকারীরা সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে হাসপাতালের আমন্ত্রণপত্রে রোগীর পাসপোর্ট নম্বর ও চিকিৎসার ধরণ পরিষ্কারভাবে লেখা না থাকলে ভিসা আটকে যায়।”
ঢাকার শীর্ষ এক হাসপাতালের ডাক্তার মতিউর রহমান বলেন—
“অনেক রোগী আগে থেকে সঠিক পরামর্শ না নিয়ে সরাসরি আবেদন করেন। এতে সময় নষ্ট হয়। প্রথমে স্থানীয় ডাক্তারের রেফারেন্স নিয়ে তারপর ভিসার জন্য চেষ্টা করাই উত্তম।”
ভিসা প্রত্যাখ্যানের সাধারণ কারণ
১. আমন্ত্রণপত্রে রোগীর তথ্য অস্পষ্ট থাকা।
২. ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ না থাকা।
৩. পূর্ববর্তী ভিসার শর্ত ভঙ্গ।
৪. পাসপোর্টের মেয়াদ ৬ মাসের কম থাকা।
৫. মিথ্যা তথ্য প্রদান।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হওয়ায় আগামী দিনে ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে মেডিকেল ট্যুরিজম বাড়ছে, যা শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় বরং অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ সরকারও ভারতীয় হাসপাতালগুলোর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে রোগীদের জন্য বিশেষ সুবিধা চালু করতে কাজ করছে।
ভারত বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য চিকিৎসার অন্যতম প্রধান গন্তব্য। তবে চিকিৎসার পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়াটি অনেকের কাছে কঠিন মনে হয়। অথচ সঠিক নিয়ম জানা থাকলে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকমতো প্রস্তুত করলে মেডিকেল ভিসা পাওয়া একেবারেই সহজ।
২০২৫ সালে ভারতীয় মেডিকেল ভিসা আবেদনের নিয়ম ও প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। তাই রোগী ও তাদের পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে এবং দালালের উপর নির্ভর না করে নিজে আবেদন করা উচিত।
শুধু চিকিৎসা নয়, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, আস্থা ও সহযোগিতার প্রতীক হিসেবেও মেডিকেল ভিসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
No comments
Thank you, best of luck