header ads

মুখস্থের বেড়াজালে: বিপর্যস্ত শৈশব



শহরের এক ছোট্ট গলির শেষে একটা ধূসর রঙা দোতলা ভাঙাচোরা বাড়ি। জানালার ধারে একটি ছেলেকে প্রতিদিন দেখা যায়—কোনোদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে, কখনো বা চোখ দুটো স্থির করে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, যেন আকাশের নীলত্বেও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরে। তার নাম তানিম। বয়স চৌদ্দ। ক্লাস নাইনের ছাত্র।
তানিমের জীবন ছিল না কোনো রঙিন ক্যানভাস। ছিল একরঙা—বইয়ের কালো অক্ষরের মতোই নিরাবেগ, চাপময়। প্রতিদিন ভোরে উঠে মুখস্থ করতে হয়—বাংলা ব্যাকরণ, পদার্থবিজ্ঞান, রচনার ধাঁচ, উদাহরণ, সংজ্ঞা। যেন মুখস্থ করার এক অন্তহীন খেলা, যেখানে ভুল করলে শাস্তি, আর নিখুঁত হলে কৃতিত্ব।

মা রুনা বেগম প্রতিদিন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কপালে একটু ভাঁজ পড়ে, ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কিছু বলতে পারেন না। কী-ই বা বলবেন? চারদিকে তো সবাই বলে—পড়লে বড়ো হওয়া যায়, মুখস্থ করলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। কিন্তু কোনোদিন কেউ জিজ্ঞাসা করেনি—"তুমি কেমন আছো?"

একদিন বিকেলে রান্নাঘরে কাজ করতে করতে রুনা বেগম বললেন, “তুই একটু খেলতে যা না রে বাইরে? বন্ধুদের সঙ্গে দেখা কর, একটু হাওয়া খেয়ে আয়।”

কিন্তু তার বাবার চোখের দিকে তাকানো যায় না। বাবা অন্য কারো থেকে এক নম্বর কম পেলেও ভীষণ রাখারাখি করে তা মনে করে-
তানিম ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয়, “সময় নেই মা, সামনে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। এখনো জীববিজ্ঞানের ‘কোষবিভাজন’ জীবনীশক্তি, রসায়নের পর্যায় সারণি; খনিজসম্পদ, রাসায়নিক বিক্রিয়া পুরো মুখস্থ হয়নি।”
মা চুপ করে যান, কিন্তু তার চোখে অদৃশ্য এক জলরেখা জমে ওঠে।

তানিমের রোজকার রুটিন ছিল যন্ত্রচালিত। সকালে বাসায় টিচারের কাছে পড়া, স্কুলে যাওয়া, বিকেলে কোচিং, রাতে রিভিশন। আর সেই রুটিনে সৃজনশীলতা ছিল নিষিদ্ধ শব্দ। সে একদিন ক্লাসে সাহস করে জিজ্ঞেস করে-
“স্যার, যদি নিজের ভাষায় উত্তর দিই, তাও কি নাম্বার পাব না?”

রফিক স্যার বিরক্ত হয়ে কড়া গলায় বলেন, “বোর্ডে যা আছে তাই লিখবা। বেশি পণ্ডিতি ফলানোর দরকার নেই। পণ্ডিতি পরেও করা যাবে। নাম্বার চাস তো মুখস্থ কর।”

সেদিন থেকে তানিম আর কখনও প্রশ্ন করেনি।

একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে বাড়ির কাছে কাছে এসে রোদের মাঝে হঠাৎ ছেলেটি ঝাপসা দেখতে শুরু করে। মাথা ঘোরে, পা কাঁপতে থাকে, আর হঠাৎ করেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চারদিকে হইচই। কেউ একজন তার মাকে ফোনে খবর দেয়, কেউ কেই পানির বোতল হাতে ছুটে এসে মাথায় পানি দেয়।

রুনা বেগম দৌড়ে এসে ছেলেকে কোলে তোলেন। যেন তাঁর বুকের মধ্যে ধসে পড়ে একটা পৃথিবী।

হাসপাতালের বিছানায় ছেলের নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার যা বলেন, তাতে তিনি স্তব্ধ হয়ে যান— “ওভারস্ট্রেসড। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ঘুমের ঘাটতি। শুধু পড়ালেখা নয়, এর মধ্যে প্রচণ্ড চাপের একটা বিষক্রিয়া কাজ করছে। এমন চললে ভবিষ্যতে উদ্বেগ, হতাশা, এমনকি অবসাদও হতে পারে।”

রাতের গভীরে, যখন সারা হাসপাতাল নিস্তব্ধ, তানিমের মা ছেলের কপালে হাত রেখে নিঃশব্দে কাঁদেন। তাঁর চোখ দিয়ে যেন সমস্ত অব্যক্ত প্রশ্ন ঝরে পড়ে—আমরা কি সত্যিই ছেলেমেয়েদের মানুষ করছি, না কি কেবল তাদের যন্ত্র বানাচ্ছি?

হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর, তানিম বদলে যেতে থাকে। তার চোখে অদ্ভুত এক বিষন্নতা, মনে চলতে থাকে এক অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। সে ভাবে—“এই মুখস্থপাঠেই কি আমার জ্ঞান? না কি শুধু পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া এক কৃত্রিম অস্তিত্ব?”
সেই দ্বন্দ্বের মাঝে একদিন সে নিজের খাতার এক কোণে লিখে ফেলে-
মাথার ভেতরে শিকল বাঁধা,
মনটা যেন বন্দি খাঁচা।
শিক্ষা নয়, কেবল ঢাসা,
শ্বাস নিতে লাগে ভয়।
উত্তর মুখস্থ নয়—?
গাধার তকমা পাও।
নব ভাবনার বন্ধ দরজা,
জ্ঞান সেখানে বিলাসিতা।

এই কবিতা কাউকে দেখায় না, কিন্তু নিজে পড়তে পড়তে তার চোখে একরাশ অদ্ভুত জ্বলজ্বলে আলো জন্ম নেয়—যেন ভেতরের কোনো অন্ধকার কোণ আলোকিত হয়ে উঠছে।

কয়েক সপ্তাহ পর স্কুলে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। বিষয়—“শিক্ষা: মুখস্থ না ভাবনার চর্চা?”

তানিম সাহস করে অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো সে তার মনের কথা লেখে। নিজের অভিজ্ঞতা, সেই হাসপাতালের রাত, মায়ের চোখের জল, তার লেখা কবিতার কয়েক লাইন, আর একটা ছোট্ট গল্প—এক পাখির, যে ছোটবেলা থেকেই কেবল গাইতে বলা গান মুখস্থ করেছে, কিন্তু একদিন যখন তাকে গান গাওয়ার জন্য ডাকা হয় তখন সে কিছুই গাইতে পারে না। কারণ গানের সুর নয়, মুখস্থ শব্দই তার সব মনে ছিল।

তার গল্প পড়ে বিচারকরা স্তব্ধ হয়ে যান। রফিক স্যারও কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতে পারেন না। পরে ফিসফিস করে বলেন, “আমরা কি ভুল পথে হাঁটছি?”

তানিম পুরস্কার পায়নি। কারণ তার লেখা প্রবন্ধের নির্ধারিত কাঠামো মেনে হয়নি। কিন্তু প্রধান শিক্ষক বিদগ্ধ মানুষ তিনি বিষয়টি জেনে, তাকে ডেকে নিয়ে বলেন-
“তোমার লেখা আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে। বিচারকগণ ও আমি তোামার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মনের অজান্তে আমার চোখে জল এসেছে। এ উপহারটি তুমি রাখ এটা আমার পক্ষ তোমাকে শুভেচ্ছা বার্তা। আমি তোমার উত্তরোত্তর আরো সাফল্য কামনা করি।

তারপর ধীরে ধীরে স্কুলে কিছু পরিবর্তন শুরু হয়। কিছু শিক্ষক প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি চালু করেন। পড়ালেখায় আলোচনা শুরু হয়, শ্রেণিকক্ষে গল্প বলার রেওয়াজ জন্ম নেয়।

তানিম ধীরে ধীরে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। আবার কবিতা লেখে, ছবি আঁকে, পুরোনো বইয়ের পাতা উল্টে পড়ে—শুধু নাম্বারের জন্য নয়, জানার আনন্দে।
বারো বছর পেরিয়ে গেছে।

আজ সে একজন তরুণ শিক্ষক। ঢাকার একটি বিখ্যাত বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ান। ক্লাসে ঢুকে বলেন-

“তোমরা মুখস্থ করবে না। বোঝার চেষ্টা করবে। প্রশ্ন করবে। কারণ শিক্ষার আসল মানে জানার আনন্দ।”

তার ক্লাসে কেউ ঘুমায় না, অমনোযোগী হয় না। তারা শুনে—গল্প, কবিতা, আর জীবন নিয়ে কথা। সে শুধু শিক্ষক নয়, বন্ধু, অনুপ্রেরণা।

একদিন এক ছোট্ট ছাত্র ক্লাস শেষে বলে-
“স্যার, আপনি যদি আমাদের না পড়াতেন, আমি কখনও জানতাম না যে বাংলা মানে শুধু ব্যাকরণ না, একটা সৌন্দর্যও আছে।”

তানিম মুচকি হেসে বলেন,
“সুন্দর চিন্তা আর নৈতিক মূল্যবোধই শিক্ষা, মুখস্থ জ্ঞান নয়।”


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.