মানুষের মতো মানুষ কই? একজন শিক্ষকের অভিজ্ঞতায় শিক্ষা ও নৈতিকতা।। manusher-moto--manush-Koi-shikkha-naitikota
![]() |
শিক্ষকের ভাবনা |
"মানুষের মতো মানুষ গড়তে চাই: শিক্ষা ও নৈতিকতার বাস্তব চিত্র"
"সন্তান মানুষ হবে কীভাবে? একজন শিক্ষকের অন্তর্দৃষ্টি"
"নৈতিকতার অভাব কেন? শিক্ষা ও সমাজের আয়নায় উত্তর খোঁজা"
"শিক্ষা নয়, চরিত্র গঠনের বিপর্যয়: কার দায় কতটুকু?"
"শিক্ষা, পরিবার ও প্রযুক্তি—কেন কমছে মানুষের মতো মানুষ?"
"সন্তান মানুষ হবে কীভাবে? একজন শিক্ষকের অন্তর্দৃষ্টি"
"নৈতিকতার অভাব কেন? শিক্ষা ও সমাজের আয়নায় উত্তর খোঁজা"
"শিক্ষা নয়, চরিত্র গঠনের বিপর্যয়: কার দায় কতটুকু?"
"শিক্ষা, পরিবার ও প্রযুক্তি—কেন কমছে মানুষের মতো মানুষ?"
‘মানবিক মানুষ পাওয়ার উপায়।
‘একজন শিক্ষক হিসাবে অভিজ্ঞতা করেছি, প্রত্যেক পিতামাতারই স্বপ্ন ও চেষ্টা তার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। অথচ হায়! আজ দেশে মানুষের মতো মানুষের এত অভাব কেন?’
এ প্রশ্নেরই উত্তর ও তার সমাধান দেওয়ার চেষ্ট করেছি আমারেএ লেখায়-
সকালে যখন স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে, তখন শুধু একটি শ্রেণিকক্ষ নয়—আলোড়িত হয় একটি জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষকের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন বীজ হয়ে ঝরে পড়ে কোমল-উর্বর মাটিতে, যা একদিন বিশাল মহীরূহ হয়ে উঠে।
একজন শিক্ষক হিসাবে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি—প্রত্যেক পিতা-মাতা চান তার সন্তান হোক আলোকিত মানুষ, মানবিক গুণে ভরপুর, সমাজের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু আজ এমন হয়েছে যে- চারিপাশে মানুষ আর মানুষ অথচ মানুষের মতো মানুষ খুবই কম।
এই প্রেক্ষাপটে-
এ প্রশ্ন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার আয়নায় দাঁড় করিয়ে দেয়—কেন এমন হলো? কোথায় ঘটছে বিচ্যুতি? কার দায় কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একজন শিক্ষক নয়, বরং আমাদের সকলের সম্মিলিত বিবেচনায় খুঁজে নিতে হবে।
একজন শিক্ষক হিসাবে আপনার এই গভীর পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং মর্মস্পর্শী। এই প্রশ্নটি কেবল আপনার নয়, আমার মতো অনেক শিক্ষকের এবং সচেতন অভিভাবকেরও মনের কথা। প্রতিনিয়ত শ্রেণিকক্ষে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেখে আমাদেরও মনে হয়, এদের নিয়েই তো সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা, তাহলে সেই স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে এত ফারাক কেন?
একজন শিক্ষক হিসাবে এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি:
১. 'মানুষের মতো মানুষ' কথাটির সংজ্ঞাগত পরিবর্তন:
প্রথমত:
আমাদের বুঝতে হবে 'মানুষের মতো মানুষ' বলতে অভিভাবকরা ঠিক কী বোঝেন এবং সমাজ কী বোঝে। মুখে আমরা সততা, দয়া, সহমর্মিতা, দেশপ্রেমের কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে যখন দেখি একজন অসৎ মানুষ বিপুল অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার মালিক, তখন আমাদের শিক্ষার্থীদের অবচেতন মন সেই সাফল্যকেই 'যোগ্যতা' হিসাবে ধরে নেয়।
দ্বিতীয়ত:
অনেক অভিভাবক সন্তানকে সৎ হতে বলেন, কিন্তু পরীক্ষার ভালো ফলাফলের জন্য বা প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য তাকে যেকোনো 'কৌশল' অবলম্বন করতেও উৎসাহিত করেন। সন্তান তখন সততার চেয়ে সাফল্যকে বড়ো করে দেখতে শেখে। নম্বর পাওয়ার জন্য অনেক অভিভাবককে নিজে বাড়ির কাজের খাতায় লিখে দিতে দেখা গেছে। করোনার সময় বাসা-বাড়িতে সন্তানদের পরীক্ষার খাতাও লিখে দিতে দেখা গেছে। এ সব দেখে সে শেখে, নীতিবাক্যগুলো বইয়ের পাতায় অনুপম সুন্দর, বাস্তবে নয়।
২. শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা:
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত জ্ঞান ও নম্বর-ভিত্তিক, প্রজ্ঞা বা মূল্যবোধ-ভিত্তিক নয়।
ক. পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা:
পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জিপিএ-৫ বা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। এখানে নৈতিক শিক্ষা, চরিত্র গঠন, সহমর্মিতা শেখানোর সুযোগ বা গুরুত্ব কোনোটাই তেমন নেই। 'নৈতিক শিক্ষা' বিষয়টিও একটি পরীক্ষার বিষয় মাত্র, যা আত্মস্থ করার চেয়ে মুখস্থ করার প্রবণতাই বেশি।
খ. দলগত কাজের অভাব: শ্রেণিকক্ষে আমরা শিক্ষার্থীদের একে অপরের প্রতিযোগী হিসাবে তৈরি করি, সহযোগী হিসেবে নয়। ফলে তাদের মধ্যে সহযোগিতা, সহানুভূতি ও অন্যের মতকে সম্মান করার মানসিকতা তৈরি হয় না।
৩. পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রভাব: শিশুরা যা শোনে, তার চেয়ে বেশি শেখে যা দেখে।
ক. সময়ের অভাব:
জীবিকার তাগিদে বাবা-মা উভয়কেই এখন ব্যস্ত থাকতে হয়। সন্তানকে দেওয়ার মতো কোয়ালিটি টাইম বা গুণগত সময় তাদের হাতে কমে গেছে। ফলে পারিবারিক অনুশাসন, গল্প বা আড্ডার মাধ্যমে যে নৈতিকতার বীজ বপন করা হতো, তা আজ প্রায় অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের অভাবে মানসিক সমৃদ্ধিতে ঘাটতি দেখা দেয়।
খ. রোল মডেলের সংকট:
সমাজে বা গণমাধ্যমে আমরা কাদের নায়ক হিসাবে তুলে ধরছি? সৎ, জ্ঞানী ও চরিত্রবান মানুষেরা নাকি অর্থবিত্ত ও ক্ষমতাবান মবরাজ মানুষেরা বেশি প্রচার পাচ্ছেন? শিশুরা যখন দেখে অসততা, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করেও সমাজে সম্মানিত হওয়া যায়, তখন তাদের মূল্যবোধের ভিত্তিটাই নড়ে যায়।
গ. সামাজিক অবক্ষয়: চারপাশের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিশুদের মনে এই ধারণা দেয় যে, সৎ পথে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। একটি বাবা যখন সেন্ট গ্রেগরীর গেটে এক হাতে পরম মমতায় শিশুর হাতে ধরে ফোনে অপর প্রান্তের মানুষকে বলেন-তিনি বনানীতে অবস্থান করছেন। তখন ঐ শিশুটি শিখে যায় কীভাবে মিথ্যার পেলব প্রবন্ধ বানাতে হয়। এই নেতিবাচকতা তাদের আদর্শচ্যুত হতে বাধ্য করে।
৪. ডিজিটাল বিশ্বের প্রভাব:
আধুনিক প্রযুক্তির যেমন আশীর্বাদ আছে, তেমনি আছে গুরুতর অভিশাপও।
ক. আত্মকেন্দ্রিকতা: সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের আত্মকেন্দ্রিক ও তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তালোভী করে তুলছে। 'লাইক', 'কমেন্ট' ও 'শেয়ার' এর মাধ্যমে পাওয়া ভার্চুয়াল স্বীকৃতি তাদের কাছে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও সহানুভূতির চেয়ে বড়ো হয়ে উঠছে।
খ. সহানুভূতির অভাব: ভার্চুয়াল জগতে সহজেই অন্যকে আক্রমণ করা যায়, উপহাস করা যায়। এর ফলে বাস্তব জীবনেও অন্যের প্রতি অনুভূতিহীন ও কঠোর হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তারা অন্যের দুঃখ-কষ্টকে একটি 'ইমোজি' বা 'রিঅ্যাকশন' দিয়েই শেষ করে দেয়।
তাহলে আমাদের করণীয় কী?
হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। একজন শিক্ষক হিসাবে আমি বিশ্বাস করি, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার।
ক. পরিবারকে হতে হবে প্রথম পাঠশালা:
অভিভাবকদের মুখে ও কাজে এক হতে হবে। সন্তানের সামনে সততা ও নৈতিকতার আদর্শ তুলে ধরতে হবে। সাফল্য মানে শুধু টাকা বা ক্ষমতা নয়, একজন ভালো মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড়ো সাফল্য—এই বিশ্বাস সন্তানের মনে গেঁথে দিতে হবে।
খ. শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন:
শিক্ষা ব্যবস্থায় চরিত্র গঠন এবং ব্যাবহারিক নৈতিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। দলগত কাজ, সামাজিক প্রকল্প এবং খেলাধুলার মাধ্যমে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা শেখাতে হবে।
গ. শিক্ষকদের ভূমিকা:
আমাদের, শিক্ষকদের, শুধুমাত্র সিলেবাস শেষ করার দায়িত্ব নিলে চলবে না। শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা হয়ে উঠতে হবে। তাদের প্রশ্ন করতে, ভাবতে এবং সঠিক-ভুলের পার্থক্য নিরূপণ করতে শেখাতে হবে।
ঘ. সামাজিক জাগরণ:
সৎ ও চরিত্রবান মানুষদের সম্মান জানাতে হবে। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে সোচ্চার হতে হবে।
সবশেষে বলব, আপনার এই আক্ষেপই ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। কারণ সমস্যাটা চিহ্নিত করতে পারা মানেই সমাধানের অর্ধেক পথ এগিয়ে যাওয়া। অভিভাবক ও শিক্ষক—এই দুই পক্ষের সম্মিলিত ও সচেতন প্রচেষ্টাই পারে আমাদের সন্তানদের 'মানুষের মতো মানুষ' হিসাবে গড়ে তুলতে এবং এই শূন্যতা পূরণ করতে। স্বপ্নটা মরে যায়নি, শুধু তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা আরও আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
পতিতপাবন মণ্ডল
বাংলা বিভাগীয় প্রধান
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ঢাকা
No comments
Thank you, best of luck