header ads

রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই : শিশুসাহিত্য ও সাংগঠনিক আন্দোলনের পথিকৃৎ


বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, খ্যাতিমান সাংবাদিক ও শিশুসংগঠক রোকনুজ্জামান খান—সারাদেশে যিনি ‘দাদাভাই’ নামেই বেশি পরিচিত—বাংলাদেশের শিশু ও কিশোর সমাজ গঠনের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর কর্মময় জীবনের বিস্তৃতি ও অবদান এত ব্যাপক ও সুদীর্ঘ যে তা বাংলা শিশু সাহিত্য ও শিশু সংগঠন-সংস্কৃতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে চিরকাল।

রোকনুজ্জামান খান ১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে। তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। তাঁর নানা রওশন আলী চৌধুরী ছিলেন ‘কোহিনূর’ পত্রিকার সম্পাদক, যা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সংবাদ ও সাহিত্য পরিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাঁর পিতা মৌলভী মোখাইরউদ্দীন খান ও মাতা রাহেলা খাতুনের স্নেহছায়ায় তাঁর শৈশব কেটেছে পাংশায় ও নানাবাড়ি পরিবেশে। শিশুকালেই সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় এবং ছদ্মনাম ‘দাদাভাই’ ব্যবহার করে কবিতা লেখা শুরু করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে রোকনুজ্জামান খান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তৎকালীন খ্যাতনামা নারী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নূরজাহান বেগমের সঙ্গে, যিনি সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁদের এই দাম্পত্য জীবনে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যচর্চার এক উজ্জ্বল সেতুবন্ধ গড়ে ওঠে, যা তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।

রোকনুজ্জামান খানের কর্মজীবনের সূচনা কলকাতায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও তিনি সাংবাদিকতার মহান ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। এ সময় ‘ইত্তেহাদ’ নামের একটি পত্রিকায় যোগ দেন এবং এর শিশুপাতা ‘মিতালী মজলিস’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ফিরে আসেন এবং ‘ইত্তেহাদ’, ‘শিশু সওগাত’ (১৯৪৯) ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ (১৯৫১) পত্রিকায় কাজ করেন। এসব পত্রিকার শিশু ও কিশোর পাতা তাঁর সুদক্ষ সম্পাদনায় সমৃদ্ধ হয়।

১৯৫৫ সালে তিনি বাংলা দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এ যোগ দেন এবং এখানেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় কাজ শুরু করেন—‘কচি-কাঁচার আসর’ নামে শিশুদের পাতা সম্পাদনা। এ পাতার মধ্য দিয়ে তাঁর ছদ্মনাম ‘দাদাভাই’ দেশজুড়ে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। কচি-কাঁচার আসর শুধু একটি পত্রিকার শিশুপাতা ছিল না, এটি ছিল এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্র, যার মাধ্যমে রোকনুজ্জামান খান শিশুদের মনে দেশপ্রেম, নীতিবোধ, সততা, দায়িত্ববোধ ও সৃজনশীলতা জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন নিখাদ শিশুপ্রেমী। ‘কচি-কাঁচার আসর’ সম্পাদক হিসাবে শিশুদের পাঠানো অসংখ্য লেখা নিজ হাতে সংশোধন ও সম্পাদনা করতেন। নতুন লেখকদের, বিশেষত শিশুসাহিত্যিকদের এগিয়ে দিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সম্পাদিত ‘আমার প্রথম লেখা’ (১৯৫৭) গ্রন্থে সেইসব বিশিষ্ট সাহিত্যিকের লেখা সংকলিত হয়, যাঁদের প্রথম সাহিত্যকীর্তি ‘কচি-কাঁচার আসর’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।

রোকনুজ্জামান খানের রচনার ভান্ডারও ছিল সমৃদ্ধ। তাঁর মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ‘হাট্টিমাটিম’ (১৯৬২), ছড়ার বই ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’ ও ‘আজব হলেও গুজব নয়’ ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত শিশুসংকলন ‘ঝিকিমিকি’ শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। এসব রচনার মূল লক্ষ্য ছিল কোমলমতি শিশুদের চরিত্রগঠন, নীতিবোধ, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলি সঞ্চার করা।

শুধু সাহিত্যচর্চায় নয়, সংগঠক হিসাবেও তিনি অনন্য। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কচি-কাঁচার মেলা’ নামে একটি শিশু সংগঠন, যা পরে বাংলাদেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। ঢাকার সেগুনবাগিচায় এর প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। এখানে শিশুরা গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কনসহ নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘কাকলী পাঠাগার’। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিশুকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, যার মধ্যে থাকবে সততা, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম।

তাঁর এই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাধার সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কচি-কাঁচার মেলার অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে, ফলে বহু মূল্যবান বই ও দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তবুও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি আবারো সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং দেশের সর্বত্র এর শাখা বিস্তৃত করেন।

রোকনুজ্জামান খানের সৃজনশীল ও সাংগঠনিক কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (১৯৯৮), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৯), জসিমউদ্ দীন স্বর্ণপদক, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের ‘পল হ্যারিস ফেলো’ সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।

তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। পরদিন, তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘কচি-কাঁচার মেলা’ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়। আজও সে স্থান শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে এক স্মৃতিবাহী তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য ও শিশু সংগঠনের এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার অক্ষয় উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর দূরদৃষ্টি, নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় গড়া প্রতিটি উদ্যোগ আজও বাঙালি শিশুমনে স্বপ্ন ও সাহস জাগায়। তিনি যেন আজীবন বেঁচে থাকবেন প্রতিটি শিশুর হৃদয়ে, ‘দাদাভাই’ হয়ে।

পতিতপাবন মণ্ডল
বাংলা বিভাগীয় প্রধান 
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ 


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.