সাত ভাই চম্পা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
বাংলা রূপকথার জগতে এমন কিছু গল্প আছে, যেগুলো শুনলেই ছোটোবেলার কড়ারোদেলা দুপুরে কিংবা স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় দাদা-দাদি বা মায়ের কোলো পাশে বসে গল্প শোনার সেই হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো ফিরে আসে। তেমনি এক অপূর্ব রূপকথা 'সাত ভাই চম্পা'। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সংকলিত এই গল্প শুধু কল্পনার রঙিন পর্দার ওপারে থাকা এক রাজ্য আর সোনার শিকলে বাঁধা ভালোবাসার কথা বলে না—এটি বলে হিংসা, প্রতিহিংসা আর অসততার বিরুদ্ধে সত্যের জয়গাথা। বড়ো রানিদের ষড়যন্ত্র আর ছোটো রানির অবর্ণনীয় দুঃখ কেবল গল্পের বাঁক নয়—এ যেন জীবনের এক চিরন্তন সত্য: শেষমেশ সত্যেরই বিজয় হয়, মিথ্যা মুখ ঢাকে, অন্যায় ধরা পড়ে। ছোটো রানির জীবন সুখ ফিরে আসে। গল্পটি পাঠ করলে আমরা ফিরে যাব সেই পুরোনো দিনের রূপকথার জগতে—যেখানে চাঁপা ফুলের মতো সাত ভাই আর পারুল ফুলের মতো এক বোন ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিল... কথা বলেছিল ন্যায়ের আর মাতৃপ্রেম আর সত্যের।
চলুন, নতুন করে পড়ে বা শুনে নেওয়া যাক বাংলা সাহিত্যের এই চিরন্তন রূপকথা—‘সাত ভাই চম্পা’র অপূর্ব গল্প।
পতিতপাবন মণ্ডল
বাংলা বিভাগীয় প্রধান
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
১.
এক রাজার সাত রানি। দেমাকে বড়ো রানিদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটো রানি খুব শান্ত। এই জন্য রাজা ছোটো রানিকে সকলের চাইতে বেশি ভালোবাসিতেন। কিন্তু, অনেক দিন পর্যন্ত রাজার ছেলেমেয়ে হয় না। এত বড়ো রাজ্য, কে ভোগ করিবে? রাজা মনের দুঃখে থাকেন।
এইরূপে দিন যায়। কতদিন পরে- ছোটোরানির ছেলে হইবে। রাজার মনে, আনন্দ আর ধরে না; পাইক-পিয়াদা ডাকিয়া, রাজা, রাজ্যে ঘোষণা করিয়া দিলেন- 'রাজা রাজভান্ডার খুলিয়া দিয়াছেন, মিঠাইমণ্ডা মণি-মানিক যে যত পার, আসিয়া নিয়া যাও।' বড়োরানিরা হিংসায় জ্বলিয়া মরিতে লাগিল। রাজা আপনার কোমরে, ছোটোরানির কোমরে, এক সোনার শিকল বাঁধিয়া দিয়া বলিলেন, 'যখন ছেলে হইবে, এই শিকলে নাড়া দিয়ো, আমি আসিয়া ছেলে দেখিব!' বলিয়া রাজা রাজদরবারে গেলেন। ছোটোরানির ছেলে হইবে, আঁতুড়ঘরে কে যাইবে? বড়োরানিরা বলিলেন, 'আহা ছোটোরানির ছেলে হইবে, তা অন্য লোক দিব কেন? আমরাই যাইব।' বড়োরানিরা আঁতুড়ঘরে গিয়াই শিকলে নাড়া দিলেন। অমনি রাজসভা ভাঙিয়া, ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মানিক হাতে ঠাকুর-পুরুত সাথে, রাজা আসিয়া দেখেন- কিছুই না! রাজা ফিরিয়া গেলেন। রাজা সভায় বসিতে না-বসিতেই আবার শিকলে নাড়া পড়িল। রাজা আবার ছুটিয়া গেলেন। গিয়া দেখেন, এবারও কিছুই না। মনের কষ্টে রাজা রাগ করিয়া বলিলেন, 'ছেলে না-হইতে আবার শিকল নাড়া দিলে, আমি সব রানিকে কাটিয়া ফেলিব।' বলিয়া রাজা চলিয়া গেলেন। একে একে ছোটোরানির সাতটি ছেলে একটি মেয়ে হইল। আহা ছেলেমেয়েগুলি যে-চাঁদের পুতুল-ফুলের কলি। আঁকুপাঁকু করিয়া হাত নাড়ে, পা নাড়ে- আঁতুরঘর আলো হইয়া গেল। ছোটোরানি আস্তে আস্তে বলিলেন, 'দিদি, কী ছেলে হইল একবার দেখাইলি না!' বড়োরানিরা ছোটোরানির মুখের কাছে রঙ্গ-ভঙ্গি করিয়া হাত নাড়িয়া, নথ নাড়িয়া, বলিয়া উঠিল, 'ছেলে না, হাতি হইয়াছে- ওর আবার ছেলে হইবে। -কয়টা ইঁদুর আর কয়টা কাঁকড়া হইয়াছে।' শুনিয়া ছোটোরানি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিলেন। নিষ্ঠুর বড়োরানিরা আর শিকলে নাড়া দিল না। চুপিচুপি হাঁড়ি-সরা আনিয়া, ছেলেমেয়েগুলিকে তাহাতে পুরিয়া, পাঁশগাদায় পুঁতিয়া ফেলিয়া আসিল। আসিয়া, তাহার পর শিকল ধরিয়া টান দিল। রাজা আবার ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মানিক হাতে ঠাকুর-পুরুত সঙ্গে আসিলেন; বড়োরানিরা হাত মুছিয়া, মুখ মুছিয়া তাড়াতাড়ি করিয়া কতকগুলি ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা আনিয়া দেখাইল। দেখিয়া, রাজা আগুন হইয়া, ছোটোরানিকে রাজপুরীর বাহির করিয়া দিলেন। বড়োরানিদের মুখে আর হাসি ধরে না; পায়ের মলের বাজনা থামে না, সুখের কাঁটা দূর হইল; রাজপুরীতে আগুন দিয়া, ঝগড়া-কোন্দল সৃষ্টি করিয়া, ছয় রানিতে মনের সুখে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন। পোড়াকপালি ছোটোরানির দুঃখে গাছ-পাথর ফাটে, নদী-নালা শুকায়- ছোটোরানি ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী হইয়া, পথে পথে ঘুরিতে লাগিলেন।
২.
এমনি করিয়া দিন যায়। রাজার মনে সুখ নাই, রাজার রাজ্যে সুখ নাই- রাজপুরী খাঁ খাঁ করে, রাজার বাগানে ফুল ফোটে না, রাজার পূজা হয় না। একদিন মালি আসিয়া বলিল, 'মহারাজ, নিত্যপূজার ফুল পাই না, আজ যে, পাঁশগাদার উপরে, সাত চাঁপা এক পারুল গাছে, টুলটুলে সাত চাঁপা আর এক পারুল ফুটিয়া রহিয়াছে।' রাজা বলিলেন, 'তবে সেই ফুল আন, পুজা করিব।' মালিকে দেখিয়া পারুলগাছে পারুলফুল চাঁপাফুলদিগে ডাকিয়া বলিল, 'সাত ভাই চম্পা জাগ রে!' মালি ফুল আনিতে গেল। অমনি সাত চাঁপা নড়িয়া উঠিয়া সাড়া দিল-'কেন বোন পারুল ডাক রে?' পারুল বলিল, 'রাজার মালি এসেছে, পূজার ফুল দিবে কি না দিবে?' সাত চাঁপা তুরতুর করিয়া উপরে উঠিয়া গিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিতে লাগিল, 'না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর, আগে আসুক রাজা, তবে দিব ফুল!' দেখিয়া শুনিয়া মালি অবাক হইয়া গেল। ফুলের সাজি ফেলিয়া, দৌড়িয়া গিয়া, রাজার কাছে খবর দিল। আশ্চর্য হইয়া, রাজা, রাজসভার সকলে সেইখানে আসিলেন।
৩.
রাজা আসিয়া ফুল তুলিতে গেলেন, অমনি পারুলফুল চাঁপাফুলদিগে ডাকিয়া বলিল, 'সাত ভাই চম্পা জাগ রে!' চাঁপারা উত্তর দিল, 'কেন বোন পারুল ডাক রে?' পারুল বলিল, 'রাজা আপনি এসেছেন, ফুল দিবে কি না দিবে?' চাঁপারা বলিল, 'না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার বড়োরানি তবে দিব ফুল!' বলিয়া, চাঁপাফুলেরা আরও উঁচুতে উঠিল। রাজা বড়োরানিকে ডাকাইলেন। বড়োরানি, মল বাজাইতে বাজাইতে আসিয়া ফুল তুলিতে গেল। চাঁপাফুলেরা বলিল, 'না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার মেজোরানি তবে দিব ফুল!
তাহার পর মেজো রানি আসিলেন, সেজো রানি আসিলেন, নোয়া রানি আসিলেন, কনে রানি আসিলেন কেহই ফুল পাইলেন না। ফুলেরা গিয়া আকাশে তারার মতো ফুটিয়া রহিল। রাজা গালে হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। শেষে দুয়োরানি আসিলেন; তখন ফুলেরা বলিল, 'না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর, যদি আসে রাজার ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী, তবে দিব ফুল।' তখন খোঁজ-খোঁজ পড়িয়া গেল। রাজা চৌদোলা পাঠাইয়া দিলেন, পাইক বেহারারা চৌদোলা লইয়া মাঠে গিয়া ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী ছোটোরানিকে লইয়া আসিল। ছোটোরানির হাতে পায়ে গোবর, পরনে ছেঁড়া কাপড়, তাই লইয়া তিনি ফুল তুলিতে গেলেন। অমনি সুড়সুড় করিয়া চাঁপারা আকাশ হইতে নামিয়া আসিল, পারুল ফুলটি গিয়া তাদের সঙ্গে মিশিল; ফুলের মধ্য হইতে সুন্দর সুন্দর চাঁদের মতো সাত রাজপুত্র এক রাজকন্যা 'মা' 'মা' বলিয়া ডাকিয়া, ঝুপঝুপ করিয়া ঘুঁটে-কুড়ানি দাসী ছোটোরানির কোলে-কাঁখে ঝাঁপাইয়া পড়িল। সকলে অবাক! রাজার চোখ দিয়া ঝরবার করিয়া জল গড়াইয়া গেল। বড়োরানিরা ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। রাজা তখনি বড়োরানিদিগকে কঠিন শান্তি দিয়া সাত রাজপুত্র, পারুল-মেয়ে আর ছোটোরানিকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন। রাজপুরীতে জয়ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল।
লেখক-পরিচিতি:
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বিখ্যাতসব রূপকথার রচয়িতা এবং শিশু-সাহিত্যিক। প্রধানত 'ঠাকুরমার ঝুলি' নামক বইয়ের জন্যে বাঙালি পাঠকসমাজে তিনি অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার উলাইল এলাকার কর্ণপাড়া গ্রামে। লোকসাহিত্যের সংগ্রাহক, ছড়াকার, চিত্রশিল্পী হিসেবেও তিনি বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন। তাঁর সংগৃহীত জনপ্রিয় রূপকথার সংকলন- 'ঠাকুরমার ঝুলি', 'ঠাকুরদাদার ঝুলি', 'ঠানদিদির থলে' ও 'দাদা মশায়ের থলে'। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব:
'সাত ভাই চম্পা' একটি রূপকথা-জাতীয় গল্প। গল্পটিতে দেখা যায়, ছোটো রানির সন্তান হলে বড়ো রানিরা হিংসায় ফেটে পড়ে। তারা ছোটোরানির সাতটি ছেলে ও একটি মেয়েকে হাঁড়িতে করে সরা-চাপা দিয়ে পাঁশগাদায় পুঁতে রাখে। একসময় সাতটি ছেলে সাতটি চাঁপা ফুলগাছ এবং মেয়েটি একটি পারুল ফুলগাছে পরিণত হয়। মালি পূজার জন্য একদিন সেই বাগানে ফুল তুলতে গেলে পারুল তার ভাইদের ডেকে বলে 'সাত ভাই চম্পা জাগো রে'। ভাইয়েরা মালিকে ফুল না দিয়ে একে একে রাজা, বড়োরানিদের এবং সব শেষে ঘুঁটে-কুড়ানি ছোটোরানিকে ডেকে পাঠায়। ছোটোরানিকে নিয়ে আসার পর বড়োরানিদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। রাজা বড়োরানিদের রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেন এবং ছোটোরানি, সাত রাজপুত্র ও রাজকন্যা পারুলকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসেন।
মানুষের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলেও সত্য একদিন প্রকাশ পায়।
No comments
Thank you, best of luck