বিশ্বাসে মিলায়বন্তু
চন্দ্রপুর নামের সেই ছোট্ট শহরটা ঘুমিয়ে থাকত প্রাচীন এক দিঘির শান্ত জলের মতো। তার ধুলোমাখা পথের ধারে, এক জীর্ণ চালার নিচে ছিল হরিনাথ মুচির জগৎ। সেই জগৎটুকু চামড়ার গন্ধ, জুতোর আঠা আর হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দে বাঁধা। হরিনাথ কেবল মুচি ছিল না, সে ছিল একজন শিল্পী। তার হাতে চামড়ার প্রাণ পেত, একেকটা জুতো হয়ে উঠত যেন একেকটা আখ্যান। এই শিল্পই ছিল তার উপাসনা, তার জীবিকা। এই সামান্য আয় দিয়েই সে তার স্ত্রী কল্যাণী আর ছোট্ট সংসারটাকে আগলে রেখেছিল।
কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর জাদুকর। সে মানুষের রুচি বদলে দেয়, পুরোনোকে ঠেলে দেয় বিস্মৃতির আঁধারে। শহরের বুকে গজিয়ে ওঠা কাচঢাকা ঝলমলে দোকান, বিজ্ঞাপনের রঙিন হাতছানি আর যন্ত্রে তৈরি সস্তা পণ্যের দাপটে হরিনাথের হাতের কাজের কদর হারিয়ে গেল। তার যত্ন করে বানানো জুতো দোকানে পড়ে থেকে ধুলো জমাতো। মানুষ এখন আর কারিগরের ঘাম নয়, ব্র্যান্ডের নাম কিনত। বিক্রির অভাবে হরিনাথের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো খাঁ খাঁ করত। সংসার চালাতে গিয়ে তাকে জলের দরে বিক্রি করে দিতে হতো তার সাধের সৃষ্টি। জমানো পয়সা কবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। একদিন, ঘরের কোণে রাখা কল্যাণীর মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন, একজোড়া রুপোর মল বিক্রি করে চাল কিনে আনতে হলো। সেইদিন রাতে হরিনাথ এক ফোঁটা অন্নও মুখে তুলতে পারেনি। তার মনে হচ্ছিল, হাতুড়ির প্রতিটি আঘাত যেন তার নিজের বুকের ওপর পড়ছে। সে হতাশায় ভেঙে পড়ছিল।
কল্যাণী ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ এক নারী। স্বামীর চোখের ভাষা সে পড়তে পারত। সে হরিনাথের কাঁধে হাত রেখে বলত, “ভেঙে পোড়ো না। আকাশের দিকে চেয়ে দেখো, মেঘ কি চিরকাল থাকে? তার আড়ালেই তো সূর্য হাসে। উপরওয়ালা আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। বিশ্বাস রাখো, তিনিই পথ দেখাবেন।” কল্যাণীর এই বিশ্বাস হরিনাথকে শক্তি জোগাত, কিন্তু পরক্ষণেই এক গভীর অসহায়ত্ব তাকে গ্রাস করত।
শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এলো, যখন হরিনাথের কাছে বিক্রি করার মতো সম্বল বলতে ছিল মাত্র একজোড়া জুতো। দোকানে উপকরণ কেনার মতো একটি পয়সাও অবশিষ্ট ছিল না। সেই জুতোজোড়া হাতে নিয়ে সে বাজারের পথে রওনা হলো, মনটা ছিল ভারাক্রান্ত। অনেক দর কষাকষির পর জুতোজোড়া বিক্রি হলো। সেই সামান্য কয়েকটি মুদ্রা হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তার চোখে পড়ল এক জীর্ণ বস্ত্র পরিহিতা বৃদ্ধা, পথের ধারে বসে ক্ষুধায় কাঁপছে। তার চোখদুটি যেন দুটি শুকনো কুয়ো, যেখানে জীবনের সব জল শুকিয়ে গেছে। হরিনাথের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। নিজের চরম দুর্দিনেও সে এক মুহূর্ত ভাবল না। নিজের ভাগের টাকা থেকে কয়েকটি মুদ্রা বৃদ্ধার কাঁপা হাতে তুলে দিয়ে বলল, “কিছু খেয়ে নিও, মা।” বৃদ্ধার চোখ বেয়ে নামল জলের ধারা, যা ছিল কৃতজ্ঞতার নীরব আশীর্বাদ।
ঘরে ফিরে হরিনাথের মনটা একদিকে যেমন শান্ত, তেমনই ভবিষ্যতের চিন্তায় ভারাক্রান্ত। শূন্য দোকানে এসে সে দেখল, এক কোণায় আবর্জনার পাশে এক টুকরো চামড়া পড়ে আছে। হয়তো কোনো পুরোনো জুতো থেকে খুলে পড়েছে। সে ওটা তুলে নিয়ে ভাবল, “এ দিয়ে হয়তো শিশুদের জন্য একজোড়া জুতো বানানো যাবে।” গভীর রাত পর্যন্ত জেগে সে চামড়ার টুকরোটি জুতোর মাপে কেটে রাখল। শরীর আর চলছিল না, তাই ভাবল, বাকি কাজটা পরদিন সকালে করবে।
পরদিন সকালে এক অদ্ভুত হতাশা নিয়ে হরিনাথ দোকানে ঢুকল। কিন্তু যা দেখল, তাতে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। যেখানে সে চামড়ার টুকরোগুলো কেটে রেখেছিল, সেখানে পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে একজোড়া নিখুঁত, সুন্দর জুতো! এমন মসৃণ ফিনিশিং, এমন সূক্ষ্ম সেলাই—যেন কোনো অদৃশ্য শিল্পী তার তুলির টানে স্বপ্ন এঁকেছে। হরিনাথ জুতোজোড়া হাতে তুলে নিল। তার কারিগর জীবনে সে এমন নিখুঁত কাজ দেখেনি। বিস্ময়ে, আনন্দে তার চোখ ভিজে এলো। সে ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাল।
সেই জুতোজোড়া বাজারে নিয়ে যেতেই এক ধনী বণিক তা চড়া দামে কিনে নিল। হরিনাথ সেই টাকা পেয়ে প্রথমে কিছু ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্নদান করল, তারপর বাকি টাকা দিয়ে বেশ কিছুটা চামড়া আর উপকরণ কিনে আনল। তার মনে এক নতুন আশা জেগেছে।
সেদিন রাতে সে দ্বিগুণ চামড়া কেটে দোকানে রেখে দিল। পরদিন সকালে এসে দেখল, দুটি নতুন জুতো একইভাবে তৈরি হয়ে আছে—আগেরটির চেয়েও সুন্দর। এভাবেই চলতে লাগল। প্রতি রাতে হরিনাথ চামড়া কেটে রেখে যেত, আর সকালে এসে দেখত জাদুকরী হাতে তৈরি অপূর্ব সব জুতো। ধীরে ধীরে তার নাম আবার শহরে ছড়িয়ে পড়ল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে লাগল সেই আশ্চর্য সুন্দর জুতো কিনতে। হরিনাথের সংসারে আবার সচ্ছলতা ফিরে এলো।
কিন্তু তাদের মনে শান্তি ছিল না। কে বা কারা এই নিঃস্বার্থ সাহায্য করে চলেছে? একদিন রাতে কল্যাণী বলল, “চলো, আজ আমরা লুকিয়ে দেখব। যারা আমাদের এত বড় উপকার করছে, তাদের একবার চোখে দেখা উচিত।” হরিনাথও রাজি হলো। তারা দোকানের এক অন্ধকার কোণে একটা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রইল।
রাত গভীর হলো। চরাচর যখন নিস্তব্ধ, তখন চাঁদের আলো এসে পড়েছে দোকানের মেঝেতে। হঠাৎ খুটখাট শব্দে তাদের চমক ভাঙল। তারা দেখল, দেয়ালের এক ফোকর গলে তিনটি বামন আকৃতির মূর্তি দোকানে প্রবেশ করল। তাদের পরনে ছেঁড়াফাটা পোশাক, কিন্তু মুখে লেগে আছে শিশুর মতো সরল হাসি। তারা এসেই কালবিলম্ব না করে কাজে লেগে গেল। তাদের ছোট ছোট আঙুলগুলো যেন জাদুর কাঠি। কী আশ্চর্য দ্রুততায় আর নিপুণতায় তারা চামড়া কাটছে, সেলাই করছে, পলিশ করছে! তাদের কাজের মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই, আছে শুধু সৃষ্টির অনাবিল আনন্দ। ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা কাজ শেষ করে হাসতে হাসতে পথে মিলিয়ে গেল।
হরিনাথ আর কল্যাণী বিস্ময়ে হতবাক। তাদের চোখ জলে ভরে উঠল। কল্যাণী ফিসফিস করে বলল, “আহা, বেচারিরা! ওদের পরনের কাপড় কী ছেঁড়া! এই শীতে নিশ্চয়ই ওদের খুব কষ্ট হয়। আমরা কি ওদের জন্য কিছু করতে পারি না?”
হরিনাথের মনটাও কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল। সে বলল, “খুব ভালো কথা বলেছ। তুমি ওদের জন্য তিনটি সুন্দর জামা বানিয়ে দাও, আমি আমার সেরা চামড়া দিয়ে ওদের জন্য তিনটি ছোট ছোট জুতো তৈরি করব।”
পরদিন তারা পরম যত্নে সেই উপহারগুলো তৈরি করল। রাতে তারা দোকানে চামড়ার বদলে সাজিয়ে রাখল তিনটি রঙিন জামা, টুপি আর পায়ে দেওয়ার জন্য ছোট্ট তিনজোড়া জুতো। তারপর তারা আবার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রইল।
মধ্যরাতে বামনেরা এলো। দোকানে চামড়ার বদলে সুন্দর পোশাক আর জুতো দেখে তারা প্রথমে অবাক হলো। তারপর যখন বুঝল, এগুলো তাদের জন্যই, তখন তাদের আনন্দ আর দেখে কে! তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই নতুন পোশাক পরে সারা দোকানজুড়ে নাচতে শুরু করল। তাদের সেই নির্মল আনন্দের দৃশ্য দেখে হরিনাথ ও কল্যাণীর হৃদয় জুড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তারা নাচতে নাচতে বিদায় নিল।
সেই রাতের পর বামনেরা আর কখনও ফিরে আসেনি।
কিন্তু এখন আর হরিনাথের তাদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল না। বামনদের নিখুঁত কাজ দেখে দেখে তার নিজের হাতের দক্ষতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল। সে শিখে গিয়েছিল শিল্পের সূক্ষ্মতা, জেনে গিয়েছিল মানুষের মন জয় করার কৌশল। দৈব সাহায্য তাকে পথ দেখিয়েছিল, কিন্তু বাকি পথটা সে নিজের পরিশ্রমে তৈরি করে নিল। তার দোকান আবার মানুষের ভিড়ে ভরে উঠল, তবে এবার আর জাদুর জন্য নয়, তার নিজের হাতের কাজের গুণের জন্য। সে হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে সম্মানিত এবং সফল কারিগর।
পাতিতপাবন মণ্ডল
No comments
Thank you, best of luck