একটি অসমাপ্ত পরীক্ষা"
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশটা ছিল সেদিন স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি নীল। গাছগুলোও যেন বিশেষ করে সেজে উঠেছিল, কয়েকদিন বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বৃষ্টির জলে গাছগুলো বেশ সতেজ হয়ে উঠেছে। এ রকম একটি দিনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে। প্রথম পরীক্ষায় আজ অষ্টম শ্রেণির গণিত পরীক্ষা। ক্লাসের সবাই ব্যস্ত নিজের নিজের নোট আর বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে—চোখেমুখে একধরনের টেনশন।
স্বপনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সে ছিল একজন সাধারণ ছাত্র, কিন্তু তার পরিশ্রম ছিল অসাধারণ। অভাবের সংসারে বড়ো হলেও সে কখনো নিজের পড়াশোনার সাথে আপস করেনি। তার বাবা, সূত্রাপুর বাজারের একজন সবজি ব্যবসায়ী। সকাল সকাল বেরিয়ে যায়, আর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। বাবা তাকে বলতেন, ‘স্বপন, তুই যদি সত্যিকার মানুষ হস, তাহলে আমার কষ্ট সার্থক হবে।’
সেদিন সকালে স্বপনের বাবা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘আজ একটু কষ্ট লাগতেছে রে... বুকে ব্যথা করছে। কিন্তু তোর পরীক্ষা তাই কিছু বলিনি আগে। তুই যা, আমি একটু শুই।’
স্বপন দোটানায় পড়ে গেল। পরীক্ষা দিতে যাবে নাকি যাবে না—শেষ পর্যন্ত বাবার কথায় ভরসা পেয়ে স্কুল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
স্কুলে এসে সিফাত, মাহি, অ্যালবিয়ন আর করণাবরণ বড়ুয়া মিলে স্বপনকে ঘিরে ধরল। কীরে প্রস্তুতি কেমন নিয়েছিস? তোর গণিত তো ভালোই প্রস্তুত, না?" তুই আসলে গণিত ভালো বুঝিস!
সে বেশি কথা বলতে পারল না বার বার বাবার মুখটা ভেসে উঠছে।
— "হুম, শুধু পরীক্ষাটা তাড়াতাড়ি দিয়ে বাবার জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে যাব। আজ সকালে কেমন যেন লাগতেছিল বাবার..."
ক্লাসরুমে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে সে চোখ বুলিয়ে নিল। প্রথম প্রশ্নটা সে চেনেই। একটা হালকা হাসি খেলে গেল মুখে। কিন্তু হঠাৎই দরজায় একটা টোকা। একজন শিক্ষক এসে তাকে ডাকলেন বাইরে।
— "স্বপন, তুমি এখনই বাসায় যাবে। তোমার পরীক্ষার বিষয়টি আমরা দেখব। স্বপনের বুক কেঁপে উঠল। সে কোনো কথা না বলে ছুটে বেরিয়ে গেল স্কুল থেকে। রাস্তাটা যেন অজানা এক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, প্রতিটা পা যেন তাকে কোনো দুঃস্বপ্নের দিকে টেনে নিচ্ছে।
বাড়ির সামনে পৌঁছেই দেখল ভিড়। মা চিৎকার করে কাঁদছেন, পাড়া-প্রতিবেশীরা চুপচাপ। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই।
স্বপন একটানা ছুটে গেল ঘরের ভেতর—বাবা নিঃসাড় পড়ে আছেন। চোখ দুটো বন্ধ, মুখে শান্তির ছাপ, কিন্তু প্রাণহীন।
স্বপনের ভেতরের সব শব্দ থেমে গেল। সময় যেন স্থির হয়ে গেল। সে বাবার নিঃশ্বাস শুনতে চাইল, কিন্তু কিছুই নেই। তার মনে হলো, বাবার কণ্ঠে আর কোনোদিন শোনা যাবে না, "তুই মানুষ হ, স্বপন..."
এরপর কেটে গেল কয়েকদিন। স্কুল থেকে কেউ কেউ দেখতে এসেছিল—সিফাত, মাহি, অ্যালবিয়ন, করণাবরণসহ কয়েকজন স্যার-ম্যাডম তারা চুপচাপ পাশে বসেছিল, কিছু না বলেও অনেক কিছু বলেছিল।
একদিন স্কুল থেকে একটি খাম এলো—একটি চিঠি, অধ্যক্ষের স্বাক্ষর করা।
“প্রিয় স্বপন,
তোমার জীবনে হঠাৎ আসা এই বিশাল দুঃখে আমরা সবাই মর্মাহত। তোমার বাবার মৃত্যু কেবল তোমার নয়, আমাদেরও এক অপূরণীয় ক্ষতি। পরীক্ষাটি পুনরায় তোমার জন্য নেওয়া হবে। আমরা চাই, তুমি ঘুরে দাঁড়াও। বাবার স্বপ্ন স্বপনের মধ্যে দিয়ে যেন একদিন সত্যি হয়।
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিবার।
স্বপন চিঠিটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে রোদে মুখ দিল। তার চোখে জল ছিল, কিন্তু মনে এক নতুন আলোর রেখা।
সে জানত, জীবন আর আগের মতো থাকবে না। কিন্তু সে আরও জানত, পরীক্ষা তার জীবনের একটি ধাপমাত্র। সামনে আরও অনেক বড়ো পরীক্ষায় তাকে উত্তীর্ণ হতে হবে। আর প্রতিটা উত্তীর্ণের মধ্যেই থাকবে বাবাকে কাছে পাওয়ার একটি অসমাপ্ত স্বপ্ন—একটি অসমাপ্ত পরীক্ষা।
- পতিতপাবন মণ্ডল
No comments
Thank you, best of luck