ads

কর্মস্থলে প্রজন্মগত ব্যবধান ও সন্নিধান


আমাদের সমাজ বা পরিবারকাঠামোতে প্রজন্মগত ব্যবধান একটি সাধারণ বিষয়। তবে কর্মক্ষেত্রেও প্রজন্মগত ব্যবধান স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। কর্মক্ষেত্রে প্রজন্মগত ব্যবধান নিয়ে পশ্চিম বা দূর পশ্চিমের দেশগুলোতে বিস্তর গবেষণা ও আলোচনা হলেও বাংলাদেশে এটি নিয়ে বিশেষ মুক্তবাক হতে দেখা যায় না। একটি আধুনিক কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের, অভিজ্ঞতার, বিশ্বাসের ও দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের কাজ করতে দেখা যায়। যেটি একটি প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার বহুমুখী সমাধানের পথে একইসঙ্গে সুফল ও প্রতিবন্ধকতা উভয়ই বয়ে আনতে পারে। প্রতিবন্ধকতার দিকটিতে আলোকপাত করলেই প্রজন্মগত ব্যবধানের ধারণাটি বেশ গুরুতর হয়ে ওঠে। কারণ কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্মের সদস্যদের একে অন্যের থেকে বেশ ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যাশা থাকে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সহজ সমস্যার সমাধানও বেশ জটিল হয়ে ওঠে; তৈরি হতে পারে মতপার্থক্য।

বর্তমান সময়ে এসে একজন মানুষের জন্মের সময়কে বিবেচনায় নিয়ে তাকে নির্দিষ্ট একটি প্রজন্মে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জন্মের সময় অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য প্রজন্মগুলো হলো Baby Boomers (১৯৪৪-১৯৬৪); Generation X (১৯৬৫-১৯৭৯); Generation Y (১৯৮০-১৯৯৪); Generation Z (১৯৯৫-২০০৯)। এই সব প্রজন্মের রয়েছে নিজস্ব চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও মানদণ্ড, যার প্রভাব কর্মক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় এবং মিশ্র পরিস্থিতি তৈরি করে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রজন্মের এই সময়ব্যবচ্ছেদ ভৌগোলিক অবস্থান বা জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় কিছুটা কম বেশি হতে পারে।

এক প্রজন্মের তৈরি করা বিশ্বাস বা নিয়ম অন্য প্রজন্মের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে, আর সে কারণেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা অর্গানাইজেশনাল সাইকোলজির গবেষণার ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বয়সসীমাকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বাস বা চিন্তার পার্থক্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। চলমান সময়ে এ সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল, ফোরাম বা রিপোর্টে, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ রিপোর্ট।

এখন আসা যাক বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রগুলোতে। বাংলাদেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোতেও প্রজন্মগত ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। মোটাদাগে ধরলে এখানে তিনটি প্রজন্মকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রথম অংশে থাকেন তারা, যারা প্রবীণ এবং দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিলম্বে প্রযুক্তিগত সুবিধা ও ধারণা লাভ করেছেন। দ্বিতীয় অংশে আছেন তারা, যারা মধ্যবয়স্ক এবং একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন অর্থাত্ প্রযুক্তির বিশাল পরিবর্তনের উভয় পাশ প্রত্যক্ষ করেছেন। তারপর আসে কর্মক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মীদের কথা, যারা মূলত প্রযুক্তির মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা এবং সেটির ব্যবহারের বহুমাত্রিক ধারণার দৃষ্টিকোণ থেকেও কর্মক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বয়সের মানুষের মধ্যে যোগাযোগবিচ্যুতি ঘটতে পারে। কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে বয়সের তারতম্যে কর্মজীবী মানুষের সময়ের ছকে বিস্তর পার্থক্য থাকে। সেক্ষেত্রে প্রজন্মগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনায় রেখে এক প্রজন্মের মানুষ আরেক প্রজন্মের মানুষের ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স’ এবং ব্যক্তিগত সময়কে সম্মান এবং স্নেহ পরবশে দেখলে আন্তঃযোগাযোগ অনেক বেশি দৃঢ় হবে এবং তাতে কর্মক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকবে। 

এছাড়াও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও ঘটে বিড়ম্বনা। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অনেকেই ধরে নেন পরিকল্পনা প্রণয়ন; সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হবে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই। অন্যদিকে বয়োকনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতামতকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেলে তাদের পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে যেমন আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে, একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে দূরত্ব ও তিক্ততাও বাড়তে পারে। কার্যক্ষেত্রে প্রবীণ ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতাকে যেমন সমীহ করা উচিত, তেমনি নবীন কর্মীদের মতামতকে স্বাগত জানানোর মনোভাব একটি কার্যক্ষেত্রকে স্বাভাবিক রাখতে পারে। 

তবে যেহেতু এটি একটি চিরন্তন সমস্যা; তাই বিভিন্ন গবেষণায় এই সমস্যার প্রাতিষ্ঠানিক সমাধানও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। অধিকাংশ গবেষণার ফলাফল লক্ষ করলে দেখা যায়, কার্যক্ষেত্রে প্রজন্মগত ব্যবধান পূরণে কার্যকর যোগাযোগ এবং একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ বজায় রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রজন্মগত পার্থক্যের ওপর প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা প্রদান করার মাধ্যমে কর্মীদের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে বিদ্যমান চিন্তাধারা সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

এছাড়াও মেন্টরিং এবং আন্তঃপ্রজন্মীয় সংলাপের মধ্যমেও এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে; যার মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রজন্মের ব্যবধানকে কমিয়ে এনে কর্মক্ষেত্রে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে। এ সমস্যা সমাধানের নানা পথ এবং সুপারিশ বিভিন্নভাবে এলেও আমাদের দেশের সমাজকাঠামোর মধ্যেই এর প্রচলিত সমাধান রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা বয়সের তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গে ‘শ্রদ্ধা’ এবং ‘স্নেহ’ শব্দ দুইটির ব্যবহার প্রথম থেকেই শিখে আসি। সুতরাং সেটা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারলে কর্মক্ষেত্রে অনেক পরিস্থিতিই সামলে নেওয়া সম্ভব। 

পারস্পরিক বোঝাপড়া :প্রত্যেকটি প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধ উপলব্ধি করতে পারা; সামর্থ্য ও দুর্বলতা পর্যালোচনার মাধ্যমেই এই দূরত্ব ঘোচানো সম্ভব। সেইসঙ্গে আমাদের জাতিগত চিন্তাচেতনাকে সঠিকভাবে চর্চায় রাখতে পারলেই আমাদের দেশের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রই হয়ে উঠবে উত্পাদনমুখী ও পরিশীলিত। 




মোফরাদ হোসেন


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.