সহজ ভাষায় ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের বিষয়বস্তু: যেকোনো সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে সহায়ক
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় কিশোর-মন ও গ্রামবাংলার জীবনধারা চিরকালই এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে। তার লেখা “পড়ে পাওয়া” গল্পটি সেই ধারার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এটি ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত একটি বিখ্যাত কিশোরগল্প। গল্পটি আমাদের নিয়ে যায় এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায়, যেখানে কিছু কিশোর ঝড়ের পর ঝরে পড়া আম কুড়াতে গিয়ে কুড়িয়ে পায় একটি তালাবদ্ধ টিনের বাক্স। তাদের সামনে খুলে যায় এক গভীর নৈতিক দ্বন্দ্বের দ্বার।
প্রথমে তারা উত্তেজনায় ভরে ওঠে—বাক্সে নিশ্চয়ই আছে টাকা, গহনা, দামী জিনিস! বয়সে ছোট হলেও তাদের মনে লোভের ছায়া পড়ে, যেমনটা সাধারণত হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সেই লোভকে তারা সামলে নেয়। প্রলোভনের মুখে দাঁড়িয়েও তারা ভুল পথে পা বাড়ায় না। বরং তারা ভাবে, এই বাক্স কোনো গরিব অসহায় মানুষের হতে পারে, যিনি এখন নিশ্চয়ই দুঃসহ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এভাবেই গল্পটি আমাদের সামনে তুলে ধরে কিশোরদের এক অনন্য মানবিক বোধ ও দায়িত্বশীল নৈতিক অবস্থান।
গল্পের প্রধান চরিত্ররা—বিধু, সিধু, নিধু, তিনু, বাদল ও ‘কথক’—বয়সে ছোট হলেও তাদের সততা ও কর্তব্যপরায়ণতা অবাক করে পাঠককে। তারা বাক্সটি গোপনে রাখে, এরপর মালিক খুঁজে বের করার জন্য নিজেরাই উদ্যোগ নেয়। তারা দেয়ালে বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়। অনেকেই আসে, কিন্তু তাদের দাবি সঠিক না হওয়ায় তারা বাক্স তুলে দেয় না। অবশেষে এক দরিদ্র কাপালি, যার ঘরবাড়ি নদীবন্যায় ভেসে গেছে এবং যার বাক্সে ছিল মেয়ের বিয়ের গহনা ও সঞ্চিত অর্থ—সেই প্রকৃত মালিক খুঁজে পায় তাদের। তখন তারা কোনো দ্বিধা না রেখে তা ফিরিয়ে দেয়।
এই গল্পে কিশোরদের মধ্যে যেমন সততা ও কর্তব্যবোধ দেখা যায়, তেমনি স্পষ্ট হয় তাদের ঐক্যচেতনা। তারা দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, এবং যে সবচেয়ে বিচক্ষণ—বিধু—তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। গল্পে চরিত্রদের মানবিক বিবেচনাবোধ এতটাই স্পষ্ট যে তারা অন্ধকার, ঝড়, ভূতের ভয় উপেক্ষা করে ন্যায়ের পথে হাঁটে। এমনকি তারা ভেবেছিল তালা ভেঙে ফেলবে, কিন্তু পরে বিবেক জাগ্রত হয় এবং অন্যায়ের পথ পরিহার করে। তাদের এমন চরিত্র দৃঢ়তা ও বিবেচনা ক্ষমতা যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ককেও অনুপ্রাণিত করতে পারে।
গল্পটির পাঠ শিক্ষার্থীদের শেখায় সত্য, ন্যায়ের পথ অনুসরণ করতে এবং প্রলোভনের সামনে অটল থাকতে। গল্পের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, বয়সে ছোট হলেও নৈতিকতায় কিশোররাও হতে পারে অনুকরণীয়। দরিদ্র, বিপন্ন একজন মানুষের কষ্টে সহানুভূতি দেখানো এবং স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কর্তব্য পালন করার যে শিক্ষা গল্পটি দেয়, তা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও মর্মস্পর্শী।
এই গল্পের মাধ্যমে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেন—নৈতিক মূল্যবোধ, সততা ও মানবিকতা শিখবার বয়স কোনো বাধা মানে না। কিশোর মনেও থাকতে পারে সত্য ও কর্তব্যের উজ্জ্বল দীপ্তি, যা সমাজের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
No comments
Thank you, best of luck