header ads

গল্প: `দীপশিখা'


নালিয়া গ্রামের মাটি নরম, কাদামাখা—কিন্তু সেই মাটির গভীরে লুকিয়ে ছিল অদেখা সোনার কণা। সেই মাটিতেই জন্মেছিল সুমনা—একটা সাধারণ ঘরের অসাধারণ কন্যা। চোখে তার স্বপ্ন ছিল পাখির ডানার মতো হালকা, কিন্তু বুকের ভেতর জমা ছিল পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা।

বুনাগাতি বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন আভিনব স্যার—এক অভিমানী যুবক, যিনি নারীর গায়ে ছায়া পড়লেই নিজেকে দুর্বল ভাবতেন। তিনি বলতেন, “মেয়েরা ছেলেদের সমান হতে চায়—এটা তো তাদের বোকামি!”
একদিন ক্লাসে তিনি বলে বসলেন, “নারীরা কেবল রান্নাঘরের জন্যই ভালো।”

দশম শ্রেণির ‘ক’ শাখার রোল নম্বর ১ সুমনা তার কাঁচা কণ্ঠে কিন্তু দৃঢ় উচ্চারণে বলল, “স্যার, রান্নাঘরের হাঁড়ি শুধু ঝাঁজ নয়, সেখানে সেজে ওঠে একেকটা পরিবারের গল্প। আপনি হয় তো শোনেননি-‘ আপনি যদি একজন নারীকে একটি ঘর দেন, সে তাকে একটি সুখের বাড়ি বানিয়ে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে আপনাকে ফেরত দেবে। আপনি যদি তাঁকে একবিন্দু ভালোবাসা দেন, সে আপনাকে একসমুদ্র ভালোবাসা বানিয়ে ফেরত দেবে। আপনি যদি তাকে একটি শুক্রাণু দেন, সে আপনাকে একটি পরিপূর্ণ সন্তান দেবে বা একটা পূর্ণ জীবন দেবে। স্যার, নারী শুধু সমান নন তার চেয়ে বেশি কিছু। তিনি সৃষ্টি করে ধ্বংস নয়। তাই নারী পুরুষের অনেক উপরে।

আভিনব বাবু চুপ করে গিয়েছিলেন। বাইরে তখন মেঘ জমছিল। শ্রাবণের ছাঁদে সেই দিনটা ছিল আলো-ছায়ার খেলা।

সময় তার আপন গতিতে এগিয়ে চলল। নদী যেমন আপন গতিতে মোড় নেয়, সুমনাও শহরের জটিল গলিপথ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে গেল। এক পর্যায়ে ভর্তি হয় ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সমাজকল্যাণে পড়াশোনা শেষ করে সে ফিরল সেই গ্রামে, ঝরাপাতার ভেতর নতুন কুঁড়ির মতো।
সে প্রতিষ্ঠা করল “আলোঘর”—একটা শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে মেয়েরা শেখে কীভাবে নিজের স্বরকে কণ্ঠে রূপ দিতে হয়, নিঃশব্দতাকে ভাষায় রূপান্তর করতে হয়।

স্কুলের ১০ বছর পূর্তি উৎসবে আভিনব স্যার অতিথি হয়ে এলেন সেই আলোঘরে। মুখে বয়সের ভাঁজ, চোখে শ্রদ্ধার নীরবতা। তিনি তাকিয়ে দেখলেন— সেই সুমনাকে, যার কণ্ঠকে তিনি একদিন অবহেলার কালো-ছায়ায় ঢেকে দিতে  চেয়েছিলেন, আজ শত শত মেয়ের দীপশিখা সে।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে আভিনব স্যার বললেন, “আমি একদিন ভেবেছিলাম, মেয়েরা সমান হতে চায় বলেই বোকা। আজ জানলাম, তারা আসলে আগুনের মতো—তাদের স্পর্শে অন্ধকার দূর হয়ে যায়। কোনো কিছু পুড়ে ধ্বংস হয় না। তাদের গতিপথ নদীর মতো—তাকে যেই রূপ দাও, সে তাতে প্রাণ ঢেলে দেয়।” একটি টুকরো জমি তাকে দিলে সে তাকে ফুলের বাগান, আর বেঁচে থাকার ক্ষুধাহরা দেবী রূপে সৃষ্টি করতে পারে।

গ্রামজুড়ে যেন সেদিন বাতাসে গন্ধ ছিল কুন্দ ফুলের—নির্মল, নম্র, অথচ গভীর।

পতিতপাবন মণ্ডল(পাবন) 
শিক্ষক 
বাংলা বিভাগ
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ 






No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.